
।। অদিতি ফালগুনি গায়েন।।
এখন যা লিখতে হবে তাতে কোন পক্ষের প্রিয় হতে পারব না। যদিও প্রশ্ন: লিখতে হবেই বা কেন? নিজের কাজ করাই ত’ বরং ভাল। তবু না লিখে নিজের কাজেও মন দেয়া যাবেনা। দেখুন, একদিকে বঙ্গবন্ধু হলের নাম বদলে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শাহ আজিজুর রহমানের নামে দেশের কোথাও কোথাও ছাত্রাবাসের নাম রাখা হচ্ছে দেখাটা যেমন মর্মান্তিক, তেমনি পাশাপাশি একটু খারাপও লাগছে যে দেশের নানা ছাত্রাবাসের নামে আমরা আরো সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আনতে পারতাম। না হয় আমাদের অনেক বিজ্ঞানী নেই, তবু স্থপতি-সুস্থ চলচ্চিত্র নির্মাতা-গীতিকার-সুরকার-কবি-লেখক সহ অনেকের নামেই আমরা বিভিন্ন ক্যাম্পাসের নানা ছাত্রাবাসের নাম রাখতে পারতাম (হ্যাঁ, খুলনা ভার্সিটি ক্যাম্পাসেই যেমন জগদীশ চন্দ্র বসু বা জীবনানন্দ দাশের নামে হলের নামকরণ হয়েছিল। সেগুলো ত’ এবার বাতিল হলো)।
শুধু যে বড় রাজনৈতিক নেতাদের নামেই হতে হবে, যত বড় মাপেরই হোন , তা’ ত’ নয়। আমাদের নেই নেই করে কোন ক্রিড়া তারকা, কোন আঞ্চলিক গানের শিল্পী, কোন লোকগীতি সংগ্রাহক বা ভাষাবিদ…অনেকের নামেই ছাত্রাবাসগুলোর নাম হতে পরতো। গত পনেরো বছরে একটি কর্তৃত্ববাদ যে তৈরি হয়েছিল সে বিষয়ে কোন দ্বিধার অবকাশ নেই, কিন্ত ভাগ্যটা এতই খারাপ যে আমাদের ’বাম উদারনীতিক’দের চ‚ড়ান্ত ডানের পিঠে না চড়ে বিগত মধ্যপন্থী সরকারকে ফেলে দেবার ক্ষমতা ছিল না। কাজেই বামেরা এখন যতই মন খারাপ করুন যে কেন পথে একটি মেয়ে সিগারেট খেলে তাকে ’মব জাস্টিস’-এর শিকার হতে হবে, এই মবকে বহু দিন করে কখনো ’তালাল আসাদ’ আর কখনো ’চমস্কি’র নামে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। মধ্যপন্থীরাও অনুমোদন দেয়নি- তা’ নয়। বামেরা বেশি দিয়েছে। এখন আপনি ’কাঁঠালের আমসত্ব’ বা ’সোনার পাথরবাটি’ এক সাথে পাবেন না। ঢাকা ভার্সিটির যে ক্লিন শেভড কর্মচারীই ’কালের কণ্ঠ’কে নরম গলায় বললো যে ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীর ওড়না গলার দিকে ওঠায় সে বলেছে যে ’আপু- রোজার দিন। ওড়নাটা ঠিক করেন-’ এবং তাকে হাজতে পোরার পরেও সামনে গিয়ে তৌহিদি জনতা সুষ্ঠু ধর্ম পালনের জন্য তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছে যে তাকে মুক্ত করা হবে, এই মব তৈরি করা হয়েছে।
বছরের পর বছর বৈধতা দেয়া হয়েছে ঢাকার সবচেয়ে এলিট অংশ থেকে। নাম করব না তবে ঢাকার এক অত্যন্ত এলিট-আরবান-প্রাইভেট ভার্সিটির শিক্ষিকা আমার বন্ধু-তালিকায় ছিলেন। একদিন মর্নিং ওয়াকে শর্টস পরা ছবি আপলোড করার পরেই বোরখার পক্ষে বিশাল এক প্রবন্ধ শেয়ার করায় আমি তাকে মন্তব্যের ঘরে জিজ্ঞাসাই করে ফেলেছিলাম , ’কিছু মনে করবেন না- পরপর দু’টো পোস্ট কি আপনারই দেয়া?’ উত্তরে তিনি অবাক হয়ে বললেন, ’হ্যাঁ।” নি:শব্দে তাকে অ-বন্ধু করে দিই। এত পান্ডিত্য আমার ছোট মস্তিষ্কে আমি ধারণ করতে পারিনি। এখন ধানমন্ডির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ’দৃক’ গ্যালারীতে বসে আপনার ওড়না না থাকুক বা সিগারেট খান, হু কেয়ার্স?
কিন্ত রাস্তায় বের হয়ে সেটা সম্ভব না। হ্যাঁ, জুলাইয়ে টি-শার্ট পরা মেয়েরা বোরখা পরা মেয়েদের পাশে ছিল- তখন সমস্যা হয়নি- এখন কেন সমস্যা? তা’ বুদ্ধি একা আপনাদেরই বেশি? তাদের বুদ্ধি নেই? আপনারা ভেবেছিলেন আপনারা তাদের ব্যবহার করবেন- তারা আপনাদের ব্যবহার করতে পারে না? যখন সংখ্যার শতাংশ হার তাদের বহু গুণ বেশি?
একই কথা বারবার লেখা বা পুনরাবৃত্তিও অর্থহীন। ’ষোল বছরের খাদক ও ক্ষুধার্ত একই রকম ভয়ঙ্কর’ বা ’সংস্কার চাই’ জাতীয় গ্রাফিত্তিগুলো…এর ভেতর অন্তত: পাঁচ শতাংশ কিশোর-তরুণের যে একেবারে কিছু সদিচ্ছা ছিল না, তা-ও হয়তো নয়। কিন্ত আবার ভেবে দ্যাখেন কাদের উপর নির্ভর করে কাদের ফেলে দেয়া হয়েছে। বর্তমান অবস্থাই কি বেটার অপশন ছিল? এই ত’ সকালে এক মসজিদের ওয়াজের ভিডিও দেখলাম যে হুজুর বলছেন যে আগের সরকারের সময় ঘরে একটা তালা লাগালেই যথেষ্ট ছিল, এখন দশটা তালা লাগাতে হয়। তারপর মসজিদের ভেতর থেকেই শ্লোগান উঠলো যে বিগত সরকারই বার বার দরকার।
যে দেশে ব্যবসায়ীদের বাজার সিন্ডিকেট ভাঙ্গা যায় না, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের মানুষ খুন করার লাইসেন্স কাড়তে চাইলে তারা দেশ জুড়ে হরতাল ডাকে…সে দেশে কি হবে? আর এসবেরই প্রতিষেধক হিসেবে সম্ভবত: পাক আমল থেকেই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করা হয়েছে এবং তার ফলাফল এখন দেখছি।
এখন শুনুন জুলাইয়ের অংশগ্রহণকারীরা: যে মেয়ে ’টিশার্ট’ পরার আরাম পেয়ে গেছে কিন্ত তার পারিবারিক শিক্ষায় বিগত সরকার যথেষ্ট পরিমাণ ’ধার্মিক’ ছিল না বলে আবার সে মনে করতো এবং ভেবেছিল যে বিগত সরকারকে ফেলে দিয়েও সে তার ’টিশার্ট’ পরবে বোরখা পরা মেয়েটির পাশে, বোরখা পরা মেয়েটি স্বেচ্ছায় বোরখা পরুক বা ঘরের বাবা-ভাই-স্বামীর চাপে পড়–ক, তার বাবা-ভাই-স্বামীরা রাস্তায় গেলে ’টিশার্ট’ পরা মেয়েকে ’বেশ্যা’ ছাড়া কিছু মনে করতে পারবে না বা পারে না। কি করবেন? এর প্রতিকার কি? আপনারা ঠিক করেন- মহামান্য ’দৃক’ গ্যালারী থেকে শুরু করে সবাই ঠিক করেন। তৃতীয় লিঙ্গ জুলাইয়ে যোগ দিলো- এখন তৃতীয় লিঙ্গ বাদ। দ্বিতীয় লিঙ্গও বাদের পথে। থাকবে শুধু প্রথম লিঙ্গ এবং সংখ্যাগুরুর প্রথম লিঙ্গই থাকবে। এটা ত’ সবাই মিলে চাওয়া হয়েছে। আর নিজেরা বন্ধু-বান্ধব সহ যাবতীয় সরকারী প্রতিষ্ঠানে বড় পদে ঢুকে যাওয়া হয়েছে।
হ্যাঁ, বিগত সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছিল কিছুটা। তবু বইমেলায় বই বিক্রি বেশি হতো। প্রতি মাসে ’কোক’ স্টুডিওর গান খুব উচ্চমার্গের কিছু তা’ নয়- কিন্ত মানুষ তখন গান-ক্রিকেট-বই নিয়ে মেতে থাকতে পারত। এক বাম তাত্তি¡কের তখন সেটা সহ্য হয়নি যে এসব ’কোক স্টুডিও’ বাংলাদেশকে এক হাসি-আনন্দের-রূপকথার দেশ হিসেবে তুলে ধরে। এখন একদম ওনার মনের চাওয়ার মত, লিবিয়া-সিরিয়ার মতো পাথর-খুনোখুনি-আগুন খেলার দেশ হয়েছে।
যে কোন দেশের পুঁজিবাদী উত্থান পর্বে, উঠতি পুঁজিপতিরা ডাকাতির চ‚ড়ান্ত করে আবার অনেক মানুষের কর্ম-সংস্থানও করে। আমাদের এস,আলম বা দরবেশ বাবারাও তাই করেছে। পশ্চিমেও তাই হয়েছে। কিন্ত এই যে দরবেশ বাবা সালমান এফ রহমান বা এস,আলম কত লাখ লাখ মানুষের কর্ম-সংস্থানও করেছে, সেসব বাদ দিয়ে তাদের ’ডাকাতি’র খবরই প্রচারিত হয়েছে (তারা করেওছে হয়তো) আবার তাদেরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এ সরকারের সময়েই, জেলে হাস্যকর ভাবে পচছে লেখক শাহরিয়ার কবির বা অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর বা অভিনেত্রী শমী কায়সার…এর চেয়ে পরিহাস ত’ আর হয় না!
এক বাম বড় বোনের ওয়্যালে শেয়ারড একটি পোস্ট দেখে সেদিন একটি পোস্ট তাড়া-হুড়ো করে শেয়ার দিলাম। শুরুটা ভাল লেগেছিল যে শুধু নাগরিক মেয়েদের সিগারেট খাওয়াতে হৈ চৈ, পোশাক কারখানার মেয়েরা মরলে হৈ চৈ নেই? গতকাল লেখাটা পড়তে গিয়ে দেখি তিনি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদীদেরও এক হাত নিয়েছেন এবং বলেছেন যে কারখানার মেয়েদের মৃত্যুকে কেন ’মুসলিম মেয়ের মৃত্যু’ বা ’শ্রমিকের মৃত্যু’ হিসেবে দেখা হচ্ছে না? হতভম্ব হয়ে গেলাম! ’বাম’দের এ হাল হয়েছে ? শ্রমিকের মৃত্যু শুধু নয়- মুসলিম মেয়ের মৃত্যুটাও কথা- পোশাক শ্রমিক মেয়েটি বৌদ্ধ বা ক্রিশ্চিয়ান বা হিন্দু হলে সেটা বিবেচ্য নয়? এখন এমন ’বাম’ যেদেশে- সেদেশে ’বাম’ মেয়েরা সত্যি আশা করেন যে তারা টিশার্ট পরে ও সিগারেট খেয়ে ঢাকার রাস্তায় হাঁটবেন? তা-ও রোজার মাসে? আর- হে ’দৃক’-এর মহান সৈন্যরা, গত পনেরো বছর ত’ এসব হলেই বলতেন যে লীগ ফেসবুকে এসব ’কালচারাল ওয়্যার’ বা ’সাংস্কৃতিক যুদ্ধ’ জারি রাখে- এখন তবে নিজেরা কেন/ নিয়ান্ডার্থাল মানব হেন/ করিছো কালচারাল ওয়্যারের হাতাহাতি? তব ফেসবুকে?
দ্যাখেন, আপনারা যা ভাল বোঝেন! ’বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী’রা কিন্ত হুজুরদের কাছে কখনো আপনাদের ব্যক্তিগত তথ্য (আপনাদের আদর্শিক অনেক সিনিয়রের জীবনাচার সহ নানা কিছু) জানাতে যায়নি। সংস্কার সত্যি সত্যি হতে পারলে হয়তো মন্দও হতো না। কিন্ত তা’ হলো কই? সে কাজের জন্য যে মেধা-শিক্ষা-রুচি-নির্লোভ মানসিকতা প্রয়োজন, তা’ কার আছে? কোথায় আছে?
আর আমিও আছি। অগ্রজ-সতীর্থ-অনুজ অনেক লেখক-কবির মত চু-প থেকে শুধু নিজের বই-পত্রের খবর ফেসবুকে দিলেই হতো। তা’ না- জরুরি কাজ ফেলে, এসব লিখেই যাচ্ছি আর লিখেই যাচ্ছি। আরো কিছু কথা বলার ছিল। কিন্ত এক লেখায় আর কত?
লেখক: কথা সাহিত্যিক।