।। আওয়ামীলীগ পেইজ প্রতিবেদন।।
আইয়ুব খানের পতন ঘটাতে ৬৮ সালের শেষের দিকে গড়ে উঠা ছাত্র ঐক্যকে আরো কার্যকর করতে ‘৬৯ এর ৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যৌথভাবে ঐতিহাসিক ১১দফা দাবী প্রণয়ন করে। এই ১১ দফার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬দফার পুরোটাই অন্তর্ভুক্ত হয়। এতে সাক্ষর করেন ছাত্রলীগের পক্ষে আব্দুর রউফ ও খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন(মতিয়া গ্রুপ) এর সাইফউদ্দিন আহমদ মানিক ও সামসুদ্দোহা, ছাত্র ইউনিয়ন(মেনন) এর নুরুল ইসলাম ও নুর মোহাম্মদ খান এবং ডাকসুর পক্ষে ভিপি তোফায়েল আহমদ ও জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী। রাজনৈতিক ফ্রন্টে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ-ভাসানী, ন্যাপ-মোজাফফর ঐক্য না হলেও ছাত্রসংগঠনগুলোর ঐক্য আন্দোলনকে বেগবান করে এবং আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে উঠেন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমদ।
বেসিক ডেমোক্রেসি সিস্টেমে নির্বাচন বাতিলের দাবিতে ৮ জানুয়ারি ৮টি রাজনৈতিক দল মিলে ‘ডেমোক্রেটিক একশন কমিটি’- ডাক গঠন করে। ন্যাপ(মোজাফফর), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, পিডিএম, পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগ, এনডিএফ, নেজামে ইসলাম, জামাতে ইসলাম এবং আওয়ামী লীগ এতে অংশ নেয়। ‘ডাক’- এ ন্যাপ ও আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকীসব আপোষকামী ও ছয়দফা বিরোধী দল থাকায় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ এদেরকে চাপে রাখার কৌশল নেয়। ১৭ জানুয়ারী ১৪৪ ধারা মেনে ‘ডাক’ এর শান্তিপুর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচী শুরু হয়। কিন্তু কর্মসূচীর ভেতরে ছাত্ররা ৬দফা ও ১১দফার শ্লোগান শুরু করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে দেয়।
একই দিন ছাত্রদের ১১দফা দাবীতে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেই। দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে পুলিশের টিয়ারগ্যাস, লালপানি, লাঠিচার্জের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ইটপাটকেল নিক্ষেপের মধ্যে দিয়ে খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়। দুপুর ১২টার মধ্যে সারা শহর থেকে অসংখ্য মিছিল এসে জমায়েত হয় কলাভবনে। তোফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে চার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন এবং পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষনা করেন।
১৮ ও ১৯ জানুয়ারী আবারো ছাত্রদের কর্মসূচী পালিত হয় পুলিশ ও ইপিআরের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষে। “তুমি কে আমি কে?/ বাঙালি, বাঙালি”, “তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা”- এরকম বাঙালি জাতীয়তাবাদী শ্লোগানগুলো হয়ে উঠে এসময়ের আন্দোলনের প্রধান শক্তি। ২০ জানুয়ারী পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদ নিহত হলে সারাদেশে সহিংস আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ঘোষনা করে, ১১ দফা আদায় না হওয়া আন্দোলন থামবেনা। ২১ জানুয়ারি পল্টনে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশে শহীদ আসাদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এদিনও বিক্ষোভ মিছিল, সংঘর্ষ চলতে থাকে। সরকার কারফিউ জারি করে।
২৪ জানুয়ারি কারফিউ ভঙ্গ করে খন্ড খন্ড মিছিল শুরু হয়। দুপুরে লক্ষ লোকের সমাবেশ শেষে ক্রুদ্ধ মিছিল পুড়িয়ে দেয় সরকারপন্থী পত্রিকাগুলোর অফিস। কিশোর মতিউর, মকবুল, রুস্তম সহ অনেককে গুলী করে হত্যা করে পুলিশ। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহেও প্রাণহানী ঘটে। ২৫ জানুয়ারী ঘোষিত শোকদিবসে আন্দোলন চলমান থাকে। নাখালপাড়ায় শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময় নিহত হন আনোয়ারা খাতুন। ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামে প্রাণহানী আরো বাড়ে।২৮ জানুয়ারি আগরতলা মামলার প্রধান আসামী শেখ মুজিবুর রহমান আদালতে বলেন- ‘পুর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাদি দাবিয়ে রাখার জন্যই মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় আমাকে জড়িত করা হয়েছে’। আদালতে সান্ধ্য আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। এদিন গ্রেপ্তার হন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।
আন্দোলনের তীব্রতায় কথিত লৌহমানব আইয়ুব খান নমনীয় হতে থাকেন ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে। ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনের জন্য নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানকে অনুরোধ জানান। নসরুল্লাহ খান পরদিন পত্রিকাকে জানান, কারাগারে অন্তরীণ শেখ মুজিবুর রহমান ও মোজাফফর আহমদের সাথে আলোচনা করেই বৈঠক আয়োজন করতে হবে। মওলানা ভাসানী আহুত বৈঠক সম্পর্কে মতামত দিতে অস্বীকৃতি জানান। ১৭ ফেব্রুয়ারী নির্ধারিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে সরকারের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। প্যারোলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের জন্য বেগম ফজিলতুন্নেছা মুজিব দৃঢ়ভাবে শেখ মুজিবকে প্রভাবিত করেন। ছাত্রনেতৃবৃন্দও নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে অটল থাকেন।
১৫ ফেব্রুয়ারী ঢাকা সেনানিবাসের ভেতর গুলী করে হত্যা করা হয় আগরতলা মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে। পরদিন মওলানা ভাসানীর ইমামতিতে সার্জেন্ট জহুরুল হকের গায়েবানা জানাযা পরেই বিক্ষুব্দ জনতা মন্ত্রী সুলতান আহমদ ও অংশ প্রু চৌধুরীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। একই সাথে কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দিন, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি খাজা হাসান আসকারি ও আগরতলা মামলার বিচারক বিচারপতি এম এ রহমানের বাসভবনে আগুন দেয়া হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ডঃ শামসুজ্জোহাকে হত্যা করে পাকিস্তান আর্মি। জোহা হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও সহিংসতায় পরদিন সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রাণ হারান অন্ততঃ ২৫ জন।
২১শে ফেব্রুয়ারী “শহীদ দিবস”- এ ভয়াবহ বিক্ষোভের আশংকায় ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার সান্ধ্য আইন ও ১৪৪ধারা তুলে নেওয়ার ঘোষনা করে। পরদিন আইয়ুব খান ঘোষনা করেন তিনি আর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করবেন না। ২১ ফেব্রুয়ারী ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ পল্টনের জনসভায় ১১দফার ভিত্তিতে নয়া শাসনতন্ত্র রচনার দাবি জানায়।
শেষ পর্যন্ত ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব নিঃশর্ত মুক্তি লাভ করেন। একই সঙ্গে কমরেড মনি সিংহ সহ ৩৪ জন রাজবন্দী মুক্তি পান।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারী রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের একক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। দশ লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে এ সভায় সভাপতিত্ব করেন তোফায়েল আহমদ। বক্তব্য রাখেন ছাত্রলীগের খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন(মতিয়া)গ্রুপের সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, ছাত্র ইউনিয়ন(মেনন)গ্রুপের মাহবুব উল্লাহ্, এনএসএফের মাহবুবুল হক দোলন। ছাত্রনেতারা তাঁদের বক্তব্যে- ১১দফা না মানলে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ না দেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক করে দেন। এ ছাড়া ৪ মার্চ আহুত হরতালের আগেই মৌলিক গণতন্ত্রী ও পরিষদের সদস্যদের পদত্যাগের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। দশলক্ষ মানুষের বিপুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমানকে মাল্যভুষিত করে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভুষিত করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স তখন ৪৯ বছর। এর মধ্যে পাকিস্তান আমলের ২২ বছরে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি ১০ বছরের বেশী সময় ধরে কারাবন্দী থেকেছেন। বৃটিশ আমলে ছাত্র আন্দোলন, পাকিস্তান আমলে ধান কাটা শ্রমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেনী কর্মচারীদের আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন সহ অসংখ্য আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে গড়ে তুলেছেন বাংলার অধিকার আদায়ের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। ততোদিনে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছেন তিনি। বাংলার বন্ধু, “বঙ্গবন্ধু” অভিধা- কেবল তাঁর জন্যই প্রযোজ্য হয়ে উঠে।
সুত্রঃ ১। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস। ডঃ মোহাম্মদ হান্নান। ২০০৬২। বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ। ডাঃ মাহফুজুর রহমান। ২০১৪