।। এএসএম শরিফুল হাসান।।
একনায়কতন্ত্র বলতে এমন এক শাসনব্যবস্থা বোঝায়, যেখানে ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া উপেক্ষিত হয়, এবং জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকার দমন করা হয়। এই ব্যবস্থায় শাসকের ইচ্ছাই আইনের উপরে প্রাধান্য পায়, এবং জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অভাব থাকে। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি একসময় দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বিশ্বব্যাপী সম্মানিত ছিলেন, তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড একটি ভীতিকর রূপান্তরের ইঙ্গিত দেয়—তিনি এখন যুদ্ধপ্রিয়, ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন।
ইউনূস সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো, যেমন ছাত্রদের মিছিল ও সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভের জন্য তদন্ত ছাড়াই চাকরিচ্যুতির হুমকি, এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, সরাসরি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের লঙ্ঘন। ছাত্রদের সমাবেশ নিষিদ্ধ করা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সমাবেশের অধিকারের মতো সাংবিধানিক নীতির বিরুদ্ধে যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্ররা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথিকৃৎ ছিলেন, কিন্তু তাদের কণ্ঠ দমনের এই প্রচেষ্টা ইউনূসের ভীতি ও নিয়ন্ত্রণের মানসিকতাকে উন্মোচন করে।
সরকারি কর্মচারীদের বিক্ষোভের জন্য চাকরিচ্যুতির হুমকি জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির একটি স্বৈরাচারী কৌশল। এটি কর্মচারীদের অধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করে। এমনকি, একজন উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করার জন্য চারজন সিনিয়র সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতি এবং টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধের ঘটনা গণমাধ্যমের উপর নজিরবিহীন হামলা। বাংলাদেশে এমনকি রাজাকার মন্ত্রীদের আমলেও সাংবাদিকরা মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পেরেছিলেন। কিন্তু ইউনূসের শাসনে ১৮ জন সাংবাদিক কল্পিত অভিযোগে কারাগারে, এবং মিডিয়া হাউসগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে। কী প্রকাশ করা যাবে বা যাবে না, তা বিশেষ অফিস থেকে নির্দেশিত হচ্ছে। এটি যদি স্বৈরাচার না হয়, তবে স্বৈরাচারের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণের প্রয়োজন।
মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মিকে করিডোর প্রদানের একক সিদ্ধান্ত ইউনূসের যুদ্ধপ্রিয় ও স্বৈরাচারী মনোভাবের সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রকাশ। এই সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দল, নিরাপত্তা বাহিনী বা বিশেষজ্ঞদের সাথে কোনো আলোচনা হয়নি, যা একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। আরাকান আর্মি একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী, এবং তাদের সমর্থন বাংলাদেশকে আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে ফেলার ঝুঁকি তৈরি করেছে। এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে সরকারের প্রচার বিভাগ মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে—রাখাইনে দুর্ভিক্ষ বা মানবিক সংকটের গল্প তৈরি করে জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে।
এই সিদ্ধান্ত জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। সীমান্তে অস্থিতিশীলতা, অস্ত্রের বিস্তার, এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে। মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইউনূসের এই অদূরদর্শী পদক্ষেপ জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত এজেন্ডাকে প্রাধান্য দেয়, যা একনায়কতন্ত্রের স্পষ্ট লক্ষণ।
ইউনূস সরকারের এই সিদ্ধান্তগুলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তে একক ক্ষমতার প্রয়োগ, জবাবদিহিতার অভাব, এবং জনগণের কণ্ঠ রোধের প্রবণতাকে প্রতিফলিত করে। ছাত্র, শ্রমিক, এবং সাংবাদিকদের দমন, এবং আরাকান আর্মির জন্য তথাকথিত করিডোরের মতো বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ধ্বংস করছে। এই কর্মকাণ্ড জুলাই আন্দোলনের চেতনার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক, যে আন্দোলন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিল। এমন তো তারা কখনই বলেনি যে, তাদের পক্ষের লোক ছাড়া আর কেউ সিন্ধান্ত নিতে পারবে না, মত প্রকাশ করতে পারবে না। যদি বলতো তাহলে জনমানুষের সমর্থন কি তারা পেত? তাহলে কি তারা জনমানুষের আবেগ অনুভূতির সরাসরি প্রতারণা করছে না? এটা তারা নিশ্চিত করেছে, এবং এই কারনেই তাদের জেনে রাখা প্রয়োজন, আর যাই হোক, বেঈমানি আর প্রতারণা এই ভুখন্ডের মানুষ কখনই ভালো ভাবে নেই নাই।
ইউনূসের শাসন এখন ভয় ও নিপীড়নের মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তার যুদ্ধপ্রিয় নীতি এবং স্বৈরাচারী মনোভাব দেশকে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ সংকটের দিকে ধাবিত করছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে অবশ্যই স্বচ্ছ, সমন্বিত এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায়, জনগণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকি দেশকে আরও গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে।