।। রিটন খান।।
আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত? দেশত্যাগ। হ্যাঁ, আপনি ঠিক শুনেছেন—বাংলাদেশ নামক দেশটিকে একরকম নোটিশ ধরিয়ে ‘বাই বাই টাটা’ বলে ফেলেছি। কেউ কেউ দেশ ছাড়ে কান্না চেপে—পেছনে রেখে যায় শৈশবের মাঠ, বাঁশঝাড়ের হুইসেল, কিংবা দাদুর আধ-খাওয়া পান। আর আমি? আমি ছেড়েছি প্রায় গুণগুণ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে—‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি’ টাইপ উদাসীনতায়।
এই দেশ আমাকে কী দিয়েছে? জন্ম আর ভাষা—একটা মায়ের পেট, আর একটা মায়ের জিভ। ব্যস। এর বেশি চাইলে বাংলাদেশ ঝাঁঝরা হয়ে যায় আমলাতন্ত্রে, পচে যায় গণতন্ত্রে, ভ্যাপসা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক লোলুপতায়। আমি তো ভাবছিলাম জন্মেছি মানুষ হয়ে—তবে কেন শৈশবেই শিখে গেলাম ‘কোটা পেলে চাকরি, না পেলে জ্যাঠা-শালা’? যেখানে পুলিশ ভাইয়েরা ধর্ষণের প্রতিবাদে মিছিলে দাঁড়ানো মেয়েদের চোখে ‘রাজনীতি’ খোঁজে, আর টেলিভিশনে রাতে বক্তৃতা দেন এক লাল-চশমা পরা বেকার পণ্ডিত, যিনি জানেন—দেশপ্রেম মানে মুখের থুঃ।
কেউ যদি বলেন, “আরে ভাই, দেশ তো মা”—তখন আমার মনে হয়, মায়ের সংজ্ঞাটা বুঝি একটু রিভিশন দরকার। মায়েরা সন্তানের স্বাধীন চিন্তাকে ভয় পান না। আমার এই জন্মভূমি কিন্তু ভয় পায়—তোমার ধর্ম কী, কারে ভোট দিলে, মেয়েটার পোশাক কেমন, ছেলেটা কেন এত নাচে—সব নিয়ে তার অ্যালার্জির তালিকা রীতিমত প্রেসক্রিপশন ছাপানো যায়।
আমি বুঝে গিয়েছিলাম, এ দেশ শুধু আমার নাগরিকত্ব চায়, আমার নাগরিকসত্তা চায় না। তারা চায় আমি মেনে চলি—ভালো ছেলের মতো ফেসবুকে শহীদ মিনার টাইপ পোস্ট দিই, আর গোপনে অশ্লীলতা সার্চ করি। তারা চায় আমি চাকরি খুঁজি, কিন্তু প্রশ্ন না করি। চায় আমি অন্যের ব্যর্থতার পাশে দাঁড়িয়ে সাফল্য উদযাপন করি।
তাই আমি পালিয়েছি—এই ‘ভালো নাগরিক’ হওয়ার রাষ্ট্রনির্ধারিত পরীক্ষার খাতা জমা দিয়ে। বাংলাদেশ আমাকে বোনাস হিসেবে যা দিয়েছে তা শুধু একটাই: ভোগান্তি। দেশে থেকে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, এখন বাইরে এসে বোতল কিনে জল খাই—কমপক্ষে জানি, জলটা বিষ না।
যারা বলে, “নিজের দেশ ত্যাগ করলে আত্মপরিচয় হারায়”—তাদের বলতে ইচ্ছে হয়, ভাই, যদি আত্মপরিচয় বলতে বোঝো সরকারি অবহেলা, তাহলে আমিও বলি—না, আমি আত্মপরিচয় খুঁজিনি, আমি আত্মরক্ষা করেছি।
দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকতেই পারে—একজন একতলা বাড়ি ভালোবাসে, তবু ফ্ল্যাটে উঠে যায়। প্রেমিকাকে ভালোবাসে, তবু ডিভোর্স ফাইল করে।
ভালোবাসা একটা মানসিক অবস্থা, কিন্তু দেশ যদি শারীরিক নির্যাতনের আশ্রয় হয়ে ওঠে, তবে পিঠ বাঁচানোও একধরনের দেশপ্রেম। কমপক্ষে নিজেকে এতটা শ্রদ্ধা তো করাই যায়, তাই নয় কি?
লেখক: এক্টিভিস্ট।