ঢাকা, ১১ জুলাই ২০২৫: জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ১১ মাস ধরে সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চালিয়ে আসলেও কাঙ্ক্ষিত ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাবে ফিরে যাচ্ছে। আর এরই মাঝে খরচ হয়ে গেছে হাজারো জীবন, রাষ্ট্রের শত কোটি টাকা আর সময়। বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের ১১তম দিনের বৈঠকে কমিশন এই নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, সর্বদলীয় কমিটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে ব্যর্থ হলে উচ্চকক্ষের স্পিকার উচ্চকক্ষের বৈঠক ডাকবেন। এই প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোকে আরও সুনির্দিষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে, এই প্রস্তাব নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পূর্ণ ঐকমত্য এখনো অর্জিত হয়নি।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া কমিশনের কার্যক্রমে সংবিধান সংস্কার, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা, এবং নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তবে, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-সহ বেশ কয়েকটি দল বিভিন্ন প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব বাতিল করে নতুন করে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি’ গঠনের প্রস্তাবেও বিএনপি নীতিগত দ্বিমত প্রকাশ করেছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন গত ৬ জুলাই রাজশাহীতে এক সমাবেশে বলেন, “একটি রাজনৈতিক দলের কারণে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে।” তিনি আরও জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাবে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে দলীয় আনুগত্যের প্রশ্ন না ওঠে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ গত ১৮ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কার্যকর গণতন্ত্র সম্ভব নয়। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।” তিনি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের প্রস্তাবে জবাবদিহিতার অভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই মাসের মধ্যে একটি জাতীয় সনদ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে। তবে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে এই প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। ড. আলী রীয়াজ জানান, “কমিশনের লক্ষ্য একটি স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাবে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম করতে চাই।”
নির্বাচন কমিশনও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নির্দেশে ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে পাঁচটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাবটি আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তবে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলমান দ্বিমত এবং সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্যের অভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পথে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। কমিশন জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহগুলোতে আরও আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা চলবে।
এদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা চাই, নতুন বাংলাদেশে কোনো স্বৈরাচার ফিরে না আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই পদক্ষেপ দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথে একটি নতুন মোড় নিয়ে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা এবং ঐকমত্য ছাড়া এই প্রস্তাবের সফল বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।