।। ড. মামুনুর রশীদ।।
চারদিকের ধ্বংসস্তূপ, মব সন্ত্রাস, ব্যর্থ আলোচনা এবং খুন-ধর্ষণের মাঝে ইউনূস সরকার যে একটা বিষয় নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে তা হলো রেমিট্যান্স আয়। প্রবাসী বাংলাদেশীদের কষ্টার্জিত অর্থ ইউনূস তার সরকারের সাফল্য বলে চালিয়ে দিচ্ছে। অথচ আজকের এই সাফল্যের পিছনে কাজ করেছে শেখ হাসিনা সরকারের গত ষোল বছরের নীতি, আলোচনা এবং সম্পর্ক গঠন।
আসুন ডাটা দিয়ে দেখি কিভাবে শেখ হাসিনার কষ্টের ফল ছিনিয়ে নিচ্ছে ইউনূস।
ডাটা নেয়া হয়েছে ২০১৫-২০২৪ সালের জন্য। রেমিট্যান্স প্রবাহ বিলিয়ন ডলারে এবং প্রবাসী অভিবাসী কর্মীর সংখা আছে লাখে। ২০২৪ এর ডাটা আনুমানিক। ডাটা সূত্র বাংলাদেশ ব্যাংক, বিশ্ব ব্যাংক, ILOSTAT, Bureau of Manpower, Employment, and Training। বিদেশে যাওয়া প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যায় বিভিন্ন সুত্রের সাথে মেলানো কঠিন। তাই একটা সূত্রের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। যেকোনো ভুল লেখকের নিজের।
চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে গত দশ বছরে (২০১৫-২০২৪) বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৫ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ২৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। রেমিট্যান্স এন্টি সাইক্লিক্যাল এবং এর ইমোশনাল দাম অনেক বেশি। তার মানে যখন দেশ অর্থনৈতিক মন্দায় পতিত হয়, তখন প্রবাসীরা রেমিট্যান্স বেশি পাঠান। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ এর কারণে সারা দুনিয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বন্ধ হয়নি, বরং বেড়েছে।
রেমিট্যান্সের এই ঊর্ধ্বগতি সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন কারণে। রেমিট্যান্স প্রবাহ মূলত বিদেশে প্রেরিত অভিবাসী কর্মীর সংখ্যার দ্বারা প্রভাবিত হয়। কর্মীর সংখা যত বাড়বে, রেমিট্যান্স তত বেশি আসবে। এর পিছনে কাজ করে সরকারের নীতি এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের সাথে বাংলাদেশের সরকারের প্রধানের সম্পর্ক। সর্বশেষ ২০২৪ সালে বাংলাদেশের কর্মজীবী শ্রমিকেরা পৌঁছে গেছে বিশ্বের ১৫০ এর উপর দেশে।
এছাড়াও, শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উপর প্রণোদনা দেয়া, অতিরিক্ত আয়কর ধার্য না করা, এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুধে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো শেখ হাসিনার সময়ে।
২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শ্রমিকের বিদেশ যাওয়ার পরিমাণ অনেক কমে গিয়েছিল। ২০১৭ সালে যেখানে প্রায় ১০.০৯ লাখ শ্রমিক দেশের বাহিরে যায়, ২০১৮ সালে যায় ৭.৩৪ লাখ, ২০১৯ এ ৭ লাখ, এবং ২০২০ এ ২.১৮ লাখ।
২০২১ থেকে আবার এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ সাড়ে বারো লাখ শ্রমিক বিদেশে প্রেরণ করতে সক্ষম হয়। ২০১৮ সালে শ্রমিকের সংখা কম হওয়া নির্বাচনী বছরের অনিশ্চয়তার সাথে জড়িত হলেও, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের বাহিরে শ্রমিক যাওয়া নির্ভর করছিলো গ্রহণকারী দেশ এবং বাংলাদেশের কোভিড-১৯ নীতি, টিকাদান এবং সময়মত টেস্ট রিপোর্ট পাওয়ার উপর।
শেখ হাসিনা সরকার খুব সাফল্যের সাথে অন্য অনেক দেশের আগে বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য টিকা এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টেস্ট রিপোর্টের ব্যবস্থা করে পরিস্থিতির ধ্রুত নিয়ন্ত্রণ নেন। যার কারণে ২০২১ সালে কোভিডের মধ্যেই বাংলাদেশ ৪ লাখ অতিরিক্ত শ্রমিক বিদেশে প্রেরণ করতে পেরেছিলো।
অতএব, রেমিট্যান্স এবং বিদেশগামী শ্রমিকের সংখার এই ঊর্ধ্বগতি শেখ হাসিনার নীতির প্রতি এবং বাংলাদেশী শ্রমিকদের যোগ্যতার প্রতি সমর্থনের এক প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত।
যদি তাই হয়, তাহলে একজন আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় থাকার পরেও যখন সারাবিশ্বের দরজা আমাদের শ্রমিক এবং বিদেশগামী যাত্রীদের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে ১) আমাদের শ্রমিকদের সুনাম নষ্ট হয়েছে, এবং ২) আমরা ভুল নেতৃত্ব পছন্দ করেছি।
সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকার তাদের দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের গ্রেপ্তার করেছে এই অভিযোগে যে এই শ্রমিকরা জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত এবং শেখ হাসিনা সরকারের পতনের জন্য জঙ্গিবাদে লিপ্ত ছিলো।
অথচ ইউনূস সরকার এই সমস্যার সমাধান না বের করে বাহিরের দেশগুলোর রিপোর্টকে উপেক্ষা করেছে। শ্রমিকদের আবেগকে ব্লেকমেইল করে ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতনে রেমিট্যান্সকে অর্থনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিলো।
৫০ টাকা কফির কথা বলে প্রতিনিয়ত শ্রমিকদের ব্যাগ লুট করছে এয়ারপোর্টে নিযুক্ত ইউনূস সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। এই ধরনের ভুল নীতির ফল খুব শীগ্রই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হবে।
শেখ হাসিনার সময় যে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে পরিচিত ছিল কর্মঠ শ্রমিকের দেশ হিসেবে, ইউনূস আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে জঙ্গিদের দেশ হিসেবে।
শেখ হাসিনা যে কাজ খুব সুন্দর সম্পর্কের মাধ্যমে করে গেছেন, ইউনূস সেই সাফল্যের কৃতিত্ব শুধু চুরি করেনি, সেই সম্পর্কগুলো ধ্বংস করে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
(লেখাটা লিখতে অনুপ্রাণিত করেছেন ড. জহির আহমেদ লেখক পরিচিতি: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক)