পাকিস্তানের সচেতন লেখকরা ১৯৭১ সাল থেকেই গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে বলছেন। সেই লক্ষ্যে তাঁরা ২০১২ সালে পাকিস্তানের লেখকদের লেখা সংকলিত করে কবি আহমদ সালিমের সম্পাদনায় `We Owe an Apology to Bangladesh’ নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
৭১ নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য-
আমাদের তরুণ প্রজন্ম যখন ৭১-এর গৌরবগাঁথা ভুলতে বসেছে ঠিক সে সময়ের পরিসংখ্যানে দেখা যায় ৭১-এর সঠিক তথ্য জানার পর পাকিস্তানের ৩০% মানুষ এখন মনে করে ৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধ করেছিল। ২০১৮ সালে পাকিস্তানের ২ জন তরুণ গবেষক পাকিস্তানিদের মানবতাবিরোধী অপরাধ অনুসন্ধানে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে গণকবর, বধ্যভূমি ও ভুক্তভোগীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের সফরসঙ্গী হতে পেরে এখনও আমি নিজেকে কৃতার্থ মনে করি। প্রাসঙ্গিক মনে করে ২০১৮ সালে আমার দেওয়া পোষ্টটি আবার শেয়ার করলাম-
পাকিস্তানি তরুণ লেখিকা আবেগ আপ্লুত হয়ে অশ্রুসজল নয়নে সুন্দরী বালাকে জড়িয়ে ধরলেন…
জীবন বাঁচানোর জন্য কেউ জড়িয়ে ধরেছিল মমতাময়ী মাকে কেউ লুকিয়েছিল ঝোপঝাড়ে কিংবা বাঁচার আশায় যারা পুকুর এবং ভদ্রা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল কেউ বাঁচতে পারেনি। মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ারে তাঁদের ইহ লীলা সাঙ্গ হয়েছিল। পুকুর ও ভদ্রা নদীর পানি সেদিন মানুষের রক্তে লাল বর্ণ ধারণ করেছিল। নদীতে মানুষের লাশ জোড়া লেগে ভেলার মত ভাসছিল। প্রায় ১০ হাজার নিরীহ নারী-পুরুষ ও নিষ্পাপ শিশুর লাশ পড়ে রইলো খোলা আকাশের নীচে। পাকিস্তানি হায়না ও রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচার আশায় বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মানুষ ভারতে পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্য সীমান্তবর্তী এলাকা খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে জড়ো হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি বর্বর সেনা ও রাজাকারদের পৈশাচিকতায় মূহুর্তেই ঘটে গেল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণহত্যা।
কৃষক এরশাদ মোড়ল লাশের স্তুপের মধ্যে তাঁর বাবাকে খুঁজে ফিরছিলেন। এমন সময় তিনি একটি শিশুর কান্না শুনতে পেলেন। ছুটে গিয়ে দেখলেন শিশুটি তার মৃত মায়ের দুধ খাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। পরম মমতায় শিশুটিকে নিয়ে আসলেন নিজ গৃহে। শিশুটির মায়ের মাথায় সিদুর ছিল, হাতে শাখা ছিল। তাই হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে রেখে পরম যত্নে বড় করলেন শিশুটিকে। একাত্তর সালে দেলোয়ার হোসন সাঈদী ও মুজাহিদরা জোরপূর্বক হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করেছিল। অথচ আপষে ধর্মান্তরিত করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও এরশাদ মোড়ল তা করেন নি। একেই বলে মানবতা।
কী নাম তার? বাবা- মায়ের নামই বা কী ? কী তার পরিচয়, কিছুই জানেন না এরশাদ মোড়ল। শিশুটির নাম রাখলেন সুন্দরীবালা।
৪৫ বছর পর পাকিস্তানের দু’জন তরুণ গবেষক ও লেখক হারুণ খালিদ ও আনাম জাকারিয়া একাত্তরের প্রকৃত ঘটনার সন্ধানে চুকনগরে আসলেন। দেখা করলেন সুন্দরী বালার সাথে। সুন্দরী বালা এখন মধ্য বয়সী এক নারী। সুন্দরী বালা যখন শিশু থেকে যৌবনে পদার্পন করেন, শহীদ সন্তান হওয়া সত্ত্বেও কেউ তাকে বিয়ে করতে চায়নি। নাম পরিচয়হীন কুঁড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে কে বিয়ে করবে? শেষে স্ত্রী বিয়োগ হওয়ার পর ঋষি পরিবারের এক বয়স্ক ব্যক্তির সাথে তার বিয়ে হয়।দীন-হীন এই গরীব নারী এখন পরের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন।সুন্দরী বালার জীবন সংগ্রামের করুণ কাহিনী সুন্দরী বালার মুখ থেকে শুনে পাকিস্তানের দুই মানবতাবাদী তরুণ লেখকের নয়ন অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। তাঁরা কাঁদলেন এবং উপস্থিত সকলকে কাঁদালেন। আবেগ আপ্লুত হয়ে আনাম জাকারিয়া সুন্দরী বালাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
পাকিস্তানি দুই তরুণ লেখক তাঁদের সাথে আনা কিছু উপহার সামগ্রী সুন্দরী বালাকে দিলেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা একদিন সুন্দরী বালার সমস্ত কিছু কেঁড়ে নিয়েছিল, আজ সেই পাকিস্তানের দুই মানবতাবাদী লেখক সুন্দরী বালাকে আপন করে নিলেন।
পাকিস্তান এখনও একাত্তরের গণহত্যা অস্বীকার করে। বাংলাদেশ যুদ্ধপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দিলে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে তার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠে। কিন্তু পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম এখন একাত্তরের প্রকৃত ইতিহাস জানতে চায়। পাকিস্তানের তরুণ লেখকরাও পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একাত্তরের প্রকৃত ঘটনা পাকিস্তানের জনগণকে জানাতে চায়। তাই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গত ৩ জুলাই অনুসন্ধিৎসু দুইজন তরুণ লেখক ও কবি আহমদ সালিমকে দাওয়াত দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং তাঁদেরকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন বধ্যভূমি ঘুরে দেখান এবং কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন।