ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। নদীতে মানুষের মরদেহ ভেসে ওঠা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশের বিভিন্ন নদীতে ৪৪০টি মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল, যার মধ্যে ২৯৯টি শনাক্ত এবং ১৪১টি অশনাক্ত ছিল। ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি থেকে জুলাই) ৩০১টি মরদেহ উদ্ধারের তথ্য পাওয়া গেছে। আগস্ট ২০২৪-এর পর থেকে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিচারহীনতা এবং মব কালচারের প্রতিফলন।
হত্যাকাণ্ড ও মব কালচারের উত্থান
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে মব কালচার ও প্রতিহিংসামূলক হত্যাকাণ্ড ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র (এএসকে)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ২৫৩টি মব হামলার ঘটনায় ১৬৩ জন নিহত এবং ৩১২ জন আহত হয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, জমি-সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পূর্ব শত্রুতার মতো কারণগুলো চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যেমন হিন্দু ও আহমদিয়া সম্প্রদায়, এই মব কালচারের প্রধান শিকার হয়েছেন। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২৫৮টি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে রংপুরে হিন্দু পরিবারের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া, লুটপাট এবং ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, বেগম রোকেয়ার মূর্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধের মতো সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনও ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। এইচআরএসএস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভে ১,৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ৬৭৩ জন ঢাকায় নিহত হয়েছেন। এই সময়ে ১৪৩টি শিশু ও কিশোর এবং ১৪ জন নারী নিহত হয়েছেন।
প্রায় প্রতিদিনই নদীতে মরদেহ ভেসে উঠছে
আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ চিত্র ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের আগস্ট পরবর্তী সময়ে নদীতে মরদেহ ভেসে ওঠার ঘটনা আরও তীব্র হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২৩ আগস্ট ২০২৫-এ কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গা নদী থেকে একজন নারী ও একটি শিশুসহ চারটি অশনাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই হত্যাকাণ্ডগুলোর পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রধান ভূমিকা পালন করছে। একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “নদীতে এখন মাছের চেয়ে মানুষের লাশ বেশি পাওয়া যায়। কে মারছে, কেন মারছে, কেউ জানে না। পুলিশও কিছু বলতে পারছে না। এটা যেন একটা নতুন বাংলাদেশ, যেখানে ক্ষমতাই সব।”
এক্স-এ পোস্ট করা তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ৭০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যা প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, সাপনা রানী সরকার নামে এক হিন্দু নারীর মাথাবিহীন মরদেহ আত্রাই নদী থেকে উদ্ধারের ঘটনা দেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর তদন্তে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর নিষ্ক্রিয়তা এবং বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। দ্য হিন্দুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ২৫৩টি মব হামলার ঘটনায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকে মনে করছেন, পুরোনো হিসাব মেটানোর জন্য এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে একটি পক্ষ।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এইচআরএসএস-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৩,৪০৭টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ১,১৮০ জন নিহত এবং ৩৭,০৫১ জন আহত হয়েছেন। এই সহিংসতার মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর প্রতিহিংসামূলক হামলা, বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর এবং হত্যাকাণ্ড উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার পুরানো শহরে দিনের আলোতে একটি হত্যাকাণ্ড দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতির একটি প্রকট চিত্র তুলে ধরেছে। এছাড়া, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে দ্বন্দ্ব, যেমন কুষ্টিয়ায় স্কুল কমিটির নির্বাচন বা রাজশাহীতে ভিজিডি কার্ড নিয়ে সংঘর্ষ, সহিংসতাকে আরও উসকে দিয়েছে।
ইনডেমনিটি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি দায়ী?
বাংলাদেশে লাগাতার হত্যাকাণ্ড এবং নদীতে মরদেহ ভেসে ওঠার ঘটনার পেছনে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং অপরাধীদের কার্যত ইনডেমনিটি প্রদানই মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্টের পর থেকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, জমি-সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং মব কালচারের কারণে হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এসব ঘটনার তদন্তে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা এবং বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে অপরাধীরা শাস্তি এড়িয়ে যাচ্ছে, যা তাদের আরও নির্ভয় করে তুলছে। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তি না হওয়ায় এই বিচারহীনতা গভীরতর হয়েছে, যা দেশে অরাজকতা ও হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতাকে তীব্র করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই অরাজকতা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। এইচআরএসএস এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে যে, সরকারকে অপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে এবং বিচার ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। এছাড়া, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কারিগরি সহায়তা গ্রহণ এবং সাক্ষী সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রতিবেদন এবং অন্যান্য সূত্র দেশের বর্তমান পরিস্থিতির একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। এই অবস্থা সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য একটি জরুরি সতর্কবার্তা। আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ না করা গেলে, বাংলাদেশ আরও গভীর সংকটের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।