।।মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার।।
প্যালেস্টাইনের গেরিলা বিপ্লবী নেতা, কবি, সাংবাদিক ঘাসান কানাফানি বলেছিলেন “গরদান তাক করে যে তরবারিটি ধরে রাখা আছে, তার সাথে আমার কোনও সংলাপ হতে পারেনা”।
আমাদের প্রেক্ষিতে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষদের, প্রগতিশীল মানুষদের, আমাদের নারীদের, ভিন্ন ধর্মের মানুষদের গরদানের উপরে যে তরবারিটি ধরে রাখা আছে, সেটা হচ্ছে ইসলামী ছাত্র শিবির – জামাতে ইসলামী আর তার নানান সোশ্যাল এজেন্সির ধরে রাখা তরবারি।
এখন আপনিই সিদ্ধান্ত নিন, আপনি কি এর সাথে সংলাপে বসবেন নাকি এই তরবারির বিরুদ্ধে লড়াই করবেন।
মাত্র মিনিট পাঁচেকের আলাপে ঘাসান কানাফানি দুনিয়ার সকল স্বাধীনতাকামি মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, যে তোমার স্বাধীনতার সংগ্রামকে ন্যূনতম খাটো করবে, সে আসলে তোমার পক্ষের মানুষ নয়।
ঘাসান কানাফানি’কে অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক Richard Carleton বলছেন – “এই যে গৃহযুদ্ধ চলছে …”
তাকে থামিয়ে দিয়ে কানাফানি বলছেন – “এটা কোনও গৃহযুদ্ধ নয়, এটা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ …”,
তারপরে সেই অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক আবারও বলছেন …”আচ্ছা ঠিক আছে ধরুন এই যে বিরোধ (Conflict) চলছে …”
তাকে আবারও থামিয়ে দিলেন কানাফানি, বললেন “এটা বিরোধ বা কনফ্লিক্ট নয়, এটা আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ, এটা একটা লিবারেশন ওয়ার …”
নাছোড় সাংবাদিক শেষমেশ বললেন – “আচ্ছা ঠিক আছে সেই যাই হোক বা যে নামেই ডাকা হোক না কেনো… …”
কানাফানি তাকে আবারও থামিয়ে বললেন – “ঠিক এই যায়গা থেকেই সকল সমস্যা শুরু হয়, যেই নামেই ডাকা হোক মানে কি? এর অন্য কোনও নাম নেই, এটা আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ যেখানে, একদল মানুষ লড়াই করার প্রত্যয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে জাস্টিস বা ন্যায় অর্জনের জন্যে, সেই লড়াইকে যারা গৃহযুদ্ধ বা বিরোধ বলে, তারা আর যাইই বুঝুক আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধকে বুঝবেনা এবং সেখান থেকেই সকল সমস্যার শুরু। একারণেই আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ নিয়ে তোমাদের এতো প্রশ্ন, এতো সন্দেহ …”
আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ নিয়েও গত চুয়ান্ন বছর ধরে এই একই ধরণের ঘটনা ঘটেছে – জামাত – শিবির ও তার সঙ্গীরা একে অভিহিত করেছে – “ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ”, “গন্ডগোল”, ‘দাঙ্গা”, “ভারতের ষড়যন্ত্র”, “দুই কুকুরের কামড়া কামড়ি” ইত্যাদি নানান নামে।
একটি স্বাধীনতার যুদ্ধকে আপনি যখন ভিন্ন কোনও নামে ডাকা শুরু করবেন, ভাবতে শুরু করবেন, সমস্যার শুরুটা হবে সেখান থেকেই এবং সেকারনেই আপনার সাথে আলাপের শেষ সীমাটি ওখানেই নির্ধারিত হয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধকে যারা কেবল “ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ” বা “ভারতের ষড়যন্ত্র” মনে করে, তারা অস্বীকার করে সেই সকল মুক্তিযোদ্ধাকে যারা খুব মামুলি অস্ত্র হাতে নিয়ে নিজের জীবন দেয়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। তারা অস্বীকার করে ইনসাফ বা ন্যায় পাবার জন্যে মানুষেরা নিরস্ত্র দাড়িয়েছিলো নিপীড়ক দখলদারদের মুখোমুখি। তারা অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধের গভীর গোড়ার কারণ টিকে – “বেইনসাফী”, “অন্যায্যতা”, “শোষণ” কে।
শুধু ডাকসু, জাকসু, রাকসু বা চাকসু নয়, আগামী সকল নির্বাচনে মনে রাখুন আপনার গরদান তাক করে ধরা তরবারিটির সাথে কোনও সংলাপ নয়, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামই হচ্ছে সঠিক ভুমিকা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে যারা ভিন্ন নামে অভিহিত করে তাদের সাথে সংলাপ নয়, প্রতিরোধ সংগ্রামই একমাত্র পথ।
মুক্তিযুদ্ধই বাংলাদেশের ডিফাইনিং ইভেন্ট, ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার প্রধান নিক্তি।
লেখক: এক্টিভিস্ট।