।। কবির য়াহমদ।।
ডাকসুতে ছাত্রশিবির ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে জিতেছে–এই আওয়াজ দিতে চাইবেন বিএনপির লোকজন। হতে পারে। আবার তারাও যে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করতে চায়নি, এটাও বিশ্বাস করার উপায় নাই। তারাও চেয়েছে, তবে পারেনি।
এখানে ছাত্রদলের ব্যর্থতার কারণ ভোট প্রক্রিয়া ও ঢাবি প্রশাসনে তাদের চাইতে ছাত্রশিবিরের প্রতি সহানুভূতিশীল লোকজনের সংখ্যা বেশি এবং তারা উচ্চ পদে আসীন। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং যদি হয়, তবে এখানে ছাত্রদল সুবিধা করতে পারেনি।
সাদিক কায়েম ও এসএম ফরহাদ সাবেক ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগে তারা পরিচয় গোপন রেখে রাজনীতি করে এসেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা নিজেদের ডেরায় ফিরেছে। তাদের প্রতি ছাত্রলীগের ক্ষোভ থাকলেও, এই ক্ষোভ ছাত্রদলের প্রতি ক্ষোভের বেশি হওয়ার কথা নয়।
ছাত্রদলের প্রতি ছাত্রলীগের ক্ষোভের বড় কারণ আগস্ট-পরবর্তী দেশপরিস্থিতি। এক বছরের বেশি সময় ধরে সারাদেশে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের যত লোক আক্রান্ত হয়েছে, তাতে সবচেয়ে বেশি নেতৃত্ব দিয়েছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম সরকারি ফরমানের নিষিদ্ধ করে দেওয়ার পর বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, তারা দুই-দুইবার চিঠি দিয়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিল।
ধানমন্ডির বত্রিশ পুড়িয়ে দেওয়ার নেতৃত্ব দিয়েছে বিএনপিই। সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে আ*গুন-লুট-ভা*ঙচুরে নেতৃত্ব দিয়েছে বিএনপি। মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনাগুলো, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভা*ঙতে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল বিএনপির লোকজন। বিএনপি এসব নিয়ে কেন্দ্রীয় কোন নির্দেশনা দেয়নি সত্য, তবে এই উশৃঙ্খল নেতাকর্মীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেনি।
আওয়ামী লীগ-বিএনপি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একে অন্যের বিকল্প ও প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। আওয়ামী লীগের কোন ভোট যেমন বিএনপির বাক্সে পড়ে না, তেমনি বিএনপির কোন ভোট আওয়ামী লীগের বাক্সে কোনোদিনও পড়েনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের পরিচয়ে কেউ লেখাপড়াও করতে পারছে না। তবু সংগঠনটির নীরব সমর্থক রয়েছে অগণন। এই নীরব সমর্থকেরা কোনোভাবেই ছাত্রদলের কোনো প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার কথা না। কারণ ছাত্রলীগের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের সমর্থক পর্যন্ত জানে এখনও তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিই, এবং বিএনপির কারণে তারা রাজনীতিতে ফিরতে পারছে না।
এক্ষেত্রে ডাকসুতে ছাত্রলীগের কেউ ছাত্রদলের কাউকে ভোট দেওয়ার কথা না। দেয়ওনি।
নির্বাচনে ছাত্রদলের কম ভোট পাওয়ার অন্য একটা কারণ সংগঠনটির প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীরা আস্থা রাখতে পারেনি। কয়েক মাস আগে শাহরিয়ার আলম সাম্য নামের এক ছাত্রদল নেতার হ*ত্যাকাণ্ডের পরেও ছাত্রদল দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি। নিজ সংগঠনের নেতার নি*র্মম হ*ত্যাকা*ণ্ডের পরেও বিএনপির আপসের রাজনীতির কারণে তাদের আন্দোলন হুট করে শেষ হয়ে গেছে। সংগঠনের একজন নেতাকে যেখানে রক্ষা করতে পারেনি ছাত্রদল, সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কীভাবে ভরসা রাখে তাদের ওপর?
ছাত্রদল শিবির ঠেকাতে হঠাৎ করে মুক্তিযুদ্ধপন্থী দল হয়ে যায়। কিন্তু বিএনপির সাম্প্রতিক অতীত অন্তত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নয়। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করেছে বিএনপি, জামায়াতের রাজনীতির আজীবন পৃষ্ঠপোষক ছিল বিএনপি, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য আজীবন করে এসেছে তারা, শহিদ বুদ্ধিজীবীদের দেশের প্রতি নিবেদন নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছে বারবার। এসব করে এসেছে তারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার নামে। কিন্তু আগস্ট-পরবর্তী দেশপরিস্থিতিতে জামায়াত তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ায় এখন তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথার বলার চেষ্টা করছে। এটা যে তাদের স্রেফ রাজনৈতিক কৌশল, এটা বুঝতে পেরেছে ঢাবি শিক্ষার্থীরা। ফলে হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধপন্থী অবস্থান তাদের বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।
গত এক বছরে ইন্তেরিমের সীমাহীন ব্যর্থতা সত্ত্বেও বিএনপি চুপ। তারা নির্বাচনের জন্যে আপসের রাজনীতি করছে। বিএনপির এই নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি ঢাবি শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে নেয়নি; যার প্রকাশ দেখা গেছে নির্বাচনে।
ছাত্রদলের যখন এই অবস্থা তখন ছাত্রশিবির কী করেছে এক বছরে? তারা ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশবিরোধী রাজনীতির ধারকবাহক। তারা মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে না, একাত্তরের জেনোসাইডের প্রত্যক্ষ সহযোগী; তবু গত এক বছরে তারা করেছে কৌশলী রাজনীতি। বিএনপি যখন মব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্যসহ নানা স্থাপনা ভা*ঙচুরে মত্ত, তখন জামায়াত-শিবির সামনে এসে তাতে অংশ নেয়নি। তারা সেনাপতি হয়ে বিএনপির সৈনিকদের সামনে ঠেলেছে। ফলে যেখানে যত সমালোচনা সেগুলো তাদের স্পর্শ করেনি। বিএনপির লোকজন যখন টেম্পুস্ট্যান্ডকেও বাদ রাখেনি, তখন তারা ঘর গুছিয়েছে নানা জায়গার শীর্ষ পদে। ফলে ভোটগ্রহণের দায়িত্বে যারা, তাদের বেশিরভাগকেই ছাত্রশিবিরের প্রতি সহানুভূতিশীল রূপে দেখা গেছে।
ডাকসুতে ছাত্রশিবিরের জয় হয়েছে। এই জয়ের প্রভাব পড়বে সারাদেশে। প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানে ছাত্রশিবির এই সুযোগকে কাজে লাগাবে। জনপরিসরে বিএনপির অন্তঃসারশূন্যতা প্রকাশিত হয়ে গেছে। লোকজন ভাবতে শুরু করবে, আগামী নির্বাচনেও মুখে-মুখে থাকবে ধানের শীষ, কিন্তু ভেতরে অন্য।
ডাকসুতে বিএনপির পরাজয়ের রাজনৈতিক মূল্য আছে। তারা হারিয়ে ফেলেছে অনেক কিছু; জনপরিসরে এর প্রভাব হবে বিশাল।
ছাত্রদলকে দিয়ে বিএনপি এখন পড়ে গেছে নেগেটিভ ভোটের খপ্পরে। এখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন তাদের।