।। শামীম আজাদ ।।
“হয় বাঘ, নতুবা বাঘ নয়
শৌখিন বাঘ বলে কিছু নেই”।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল
—-
সত্যি শৌখিন বাঘ বলে কিছু নেই। এ’কথাটি বলছিলেন প্রয়াত শিক্ষক, অবিস্মরণীয় বক্তা, জ্ঞানী ও অপ্রিয় সত্য কথক ও সমালোচক স্যার আবু হেনা মোস্তফা কামাল। বাংলাদেশে, ঢাকায় আমি ও আমার পরিবারের সবাই নানান পরিবেশে তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছি।ঢাবির ক্লাসরুমের সরাসরি শিক্ষক না হলেও তিনি আমার শিক্ষক হয়েওঠেন।
মনেপড়ছে তখন মাত্র শিল্পকলা একাডেমির পরিচালকের দায়িত্ব পালন শেষে বাংলা একাডমির মহা পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। ততদিনে আধিকারিক হিসেবে তাঁর ‘নির্ভীক জঞ্জাল পরিষ্কারক’ হিসেবে খ্যাতি প্রতিষ্ঠিত । আমি তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিক ও ঢাকা কলেজে বাংলা বিভাগের প্রশিক্ষক। স্যারের নিয়মিত কলাম জমা দিতে আসেন বিচিত্রায় আর শুনি কী করছেন।
বাংলা একাডেমিতে প্রবেশের পর পরই সব রদ্দি নিয়ম কানুন তছনছ করে বাংলা একাডেমি ধুয়ে দিচ্ছেন। পুরস্কারের অর্থমূল্য বাড়িয়ে সংখ্যা নামিয়ে এনেছেন দুই’এ। বলেন, ‘এত এত পুরস্কার দিলে পরে আর মানুষ পাওয়া যাবে না। তখন দিতে হবে অযোগ্যদেরও’। বিস্ময়ের সংগে একাডেমির কর্মকান্ড গুলোর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে পরিবেশনা আরো বেশি শিল্প সৌন্দর্যর কুঞ্জ হয়ে উঠলো। সংস্কৃতি সন্ধ্যায় দেখেছি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অপরিচিত গুনীজন রাজধানীর মঞ্চে উঠে এসেছেন। কথিত আছে অল্পবয়সী অসাধারণ লালনগীতির শিল্পী সদ্য প্রয়াত ফরিদা পারভিনের আবিষ্কার তাঁরই।গীতিকার আবু জাফর তাঁর ছাত্র ছিলেন।
তিনি যখন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কলাম লেখা শুরু করলেন আমরা এক ঝাঁক তরুন সাংবাদিক তাঁর লেখা জমা দেবার দিনের অপেক্ষায় থাকতাম। তিনি এলে জমবে মেলা। সে সব আড্ডার জন্য অনেক সময় আমাদের সম্পাদক, সাংবাদিক জগতের কিংবদন্তি শাহাদত চৌধুরী- শাচৌ তার দুয়ার খুলে আমাদের ডেকে নিতেন।আমরা তরুনেরা মহা উৎসাহে কাজের ফাঁকে ফাঁকে শাচৌর কক্ষে সেই আলোর-আড্ডার নির্যাস পান করতাম। আমাদের অফিস সহকারী সুন্দর আলী লাল লেবু চা’র অর্ডার নিতে নিতে আমরা প্রবেশ করা মাত্র শাচৌ তাঁর প্রতি অসমাপ্ত বিষয়টি চালিয়ে নেবার ঈঙ্গিত করে নিজে নিউজ প্রিন্ট প্যাড ছিঁড়তে লেগে যেতেন।
তেমনি এক নিরাক পরা দুপুরে শাচৌর কক্ষে চলছে লেবু চা আর স্যারের চানাচুর কথামালার হাস্যরস। এক পর্যায়ে আমি বল্লাম, স্যার আপনি কি কখনো একটিও লোককে প্রশংসা করেছেন? কপালের অবাধ্য একটি চুল সরিয়ে আমার দিকে মুখ তুলে তীর্যক ভাবে তাকিয়ে বল্লেন, কেন আনিসুজ্জামান? তারপর মৃদুস্বরে বল্লেন, প্রকৃত গুনীকে মর্যাদা দিতে আমি কখনো কার্পণ্য করি না শামীম! সে কথার প্রমান অনেক পেয়েছি। স্যারের সান্নিধ্যে কতজন বড়ো হয়ে উঠেছেন!
যেমন তাঁর বাগ্মিতার ছিলো না কোন তুলনা।তেমনি আমাদের দেশের শিল্পাঞ্চলে কৃতীদের মধ্যে ছিলো না তার প্রশাসনিক দক্ষতা ও দূরদৃষ্টিরও তুলনা। শিল্পকলা একাডেমী ও বাংলা একাডেমির গুণগত পরিবর্তনের কথা তো আপনারা সবাই অবগত আছেন।
হেনা স্যার ছিলেন পান্ডিত্যের আকর, মেধা ও মননের শীর্ষে, কবিতায় গালিব, সত্য কথনে অপ্রতিরোধ্য আর সমালোচনায় নির্মোহ।তিনি ছিলেন এক অসামান্য এক শিক্ষক। তাঁর মেধা ও জ্ঞানের সমকক্ষ খুব কম লোকই বাংলাদেশে ছিলেন এবং আছেন।কী অসামান্য কলাম লেখক ও কবি ছিলেন তিনি! ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল শিল্প সাহিত্যের যেখানেই হাত রেখেছেন সোনা ফলেছে।
অসাধারন এক কবি ছিলেন বলে তাঁর গানের কথাগুলো শুধু লিরিক নয় ছিলো নানান অভিব্যক্তির অসামান্য কবিতাও।ষাটের দশকে তাঁকেও পান আর চা দিয়ে বসিয়ে দিলে নজরুলের মতই এক বৈঠকে লিখে দিয়ে চলে যেতেন গান। সংগে গুনগুন করে গাইতেনও।
আরো শুনেছি ষাটের দশকে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা অফিসের উল্টো দিকের একটি ছোট্ট দোকানে বসে বসে তাৎক্ষণিক ভাবে গানের যোগান দিয়ে গেছেন দিনরাত। সেখানে সৈয়দ হক, আব্দুল আহাদ, আব্দুল হালিম ভাই এঁরা ছিলেন অপরিহার্য।
একদিন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কথা বলতে বলতেই নিউজ প্রিন্ট প্যাড টেনে আমারই বলপয়েন্টে তাৎক্ষণিক লিখে ফেলেছিলেন এক গান। স্যারের গালিব ভক্তি আমরা জানতাম। আমার তখন তাঁকে ‘আমাদের গালিব’ মনে হয়েছিল। গানের ব্যাপারে হেনা স্যার ছিলেন এক ঘোরগ্রস্থ মানুষ।
পারিবারিক পরিবেশে দেখেছি তাঁর স্নেহশীল মায়াময় উপস্থিতি। আমি ও আজাদ আমাদের সন্তানদের নিয়ে যখন তাঁর বাড়িতে চা খেতে গেছি দেখেছি কী ভীষণ মমতাময় এক পিতা তিনি! আমরা গেলেই শিখা, বিদ্যূৎ, পাখি ওরা সবাই আমাদের সংগে বসে পড়তো। চা এলে চমৎকার ও সুশ্রী ভাবী এসে বসতেন। তখন সুন্দরী ভাবীর প্রতি স্যারের কূটাভাসে প্রত্যক্ষ করেছি এক নিবিষ্ট প্রেমিককে।বড়কন্যার কোল জুড়ে প্রথম দৌহিত্রী এলে হয়ে গেছেন সেই সুন্দর মানব শিশুর এক অসামান্য মাতামহ! আমাদের কন্যা ঈশিতাকে খুব ভালবাসতেন। বাসায় এলে আমরা সবাই তাঁর গল্পবলা কৌতুকভরে উপভোগ করেছি!
প্রয়াত স্যারের সংস্পর্শ ও সাহস ছাড়াও পেয়েছি সততার অনুপান। বিচিত্রায় চাকুরী ও শাচৌর কারনে অসাধারন সব মানুষের কাছে যাবার সুযোগ পেয়েছি। সামনে বসে কথা শুনেছি। যতটুকু হৃদ্ধ হয়েছি তার জন্য ভাগ্য মেনেছি। মানবো বাকিটা জীবন।
আজ স্যারের প্রয়াণ দিবস,
তাঁর চরণে পুষ্প রেখে গেলাম। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫