জুলাই ২০২৪-এর জুলাই দাঙ্গার সেই রক্তাক্ত দিনগুলো বাংলাদেশের মানুষ ভুলবে না। বিদেশি অর্থে পুষ্ট জঙ্গি সংগঠন এবং সেনাবাহিনীর একাংশের সহায়তায় দেশজুড়ে দাঙ্গা সৃষ্টি করে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দেওয়া হয়। আর সেই সুযোগে ক্ষমতায় বসেন মুহাম্মদ ইউনুস — যিনি নিজেকে ‘গণতন্ত্রের রক্ষক’ দাবি করেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি গণতন্ত্রের কবর রচনা করছেন। তার সরকারের প্রথম কাজই ছিল বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করা। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করলেও তাদের কার্যক্রম স্থগিত করে দেওয়া হয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ইউনুসের যুক্তি? “তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে আচরণ করছে না”। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কে এই সিদ্ধান্ত নিল? কে এই বিচারক? ইউনুস নিজেই। তিনি নিজেকে বিচারক, জুরি, এবং জল্লাদ—সবকিছুতে পরিণত করেছেন।
অমর্ত্য সেনের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব সতর্ক করেছেন, এই পথ আগেও হাঁটা হয়েছে, এবং তার ফলাফল ছিল ধ্বংস। কিন্তু ইউনুসের কানে সেই সতর্কবাণী ঢুকেনি। তার কাছে গণতন্ত্রের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা। তিনি বলেন, “সংস্কার আগে, নির্বাচন পরে”। কিন্তু সেই সংস্কার কোথায়? এক বছরে কী পরিবর্তন হলো? গণমাধ্যমের উপর চাপ বেড়েছে, বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এবং নির্বাচন কমিশন আজ ইউনুসের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে।
আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে দেশজুড়ে যে আলোচনা, তা কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়—এটা একটা তামাশা। বিগত নির্বাচনে ২৮টি দল অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু আজ সেই দলগুলোর অধিকাংশই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। কারণ ইউনুস সরকার তাদের কার্যক্রম স্থগিত করে রেখেছে। মোস্তফা ফিরোজ, সালাহউদ্দিন আহমদ, নূরুল কবীর—প্রত্যেকে একবাক্যে বলছেন, এই নির্বাচন হবে ‘আমি আর ডামি’ নির্বাচন। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নামের কিছু থাকবে না, যেখানে জনগণের কোনো বিকল্প থাকবে না।
বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “নিষিদ্ধ যদি চাইতেই হয়, তাহলে সব দলকেই নিষিদ্ধ করতে হবে। কিন্তু তাহলে নির্বাচনটা কাদের নিয়ে হবে?” এই প্রশ্নের উত্তর ইউনুসের কাছে নেই। কারণ তার লক্ষ্য একটাই—ক্ষমতা ধরে রাখা। তিনি বলেন, “জনগণ ভোট দিতে পারবে”। কিন্তু কোন জনগণ? কোন বিকল্প? যখন প্রধান বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়েছে, তখন এই ভোটের কোনো মূল্য থাকে না।
গণমাধ্যমের উপর যে নির্যাতন চলছে, তা আরও ভয়াবহ। মোস্তফা ফিরোজ বলেছেন, “গণমাধ্যম আজ সেলফ-সেন্সরশিপের শিকার। তারা ভয়ে কাউকে ডাকতে সাহস পায় না, কারণ উপদেষ্টার অফিস থেকে ফোন আসতে পারে”। অর্থাৎ, ইউনুস সরকার শুধু রাজনৈতিক দলকেই নয়, গণমাধ্যমকেও স্তব্ধ করে দিয়েছে। যখন গণমাধ্যম ভয়ে কাঁপে, তখন গণতন্ত্রের মৃত্যু অনিবার্য।
ইউনুস বলেন, তিনি সংস্কার করতে চান। কিন্তু কোন সংস্কার? কোন পরিবর্তন? তার সরকারের এক বছরে দেশে যা হয়েছে, তা হলো গণতন্ত্রের অবসান। নির্বাচন কমিশন আজ তার অধীনস্থ, বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়েছে, এবং গণমাধ্যমকে ভয়ে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, “নির্বাচন হবে ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে”। কিন্তু কেন ১৮ মাস লাগল? নেপালে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন হলো, কিন্তু বাংলাদেশে কেন ১৮ মাস? কারণ ইউনুসের লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা, গণতন্ত্র নয়।
নূরুল কবীর বলেছেন, “ইউনুস সরকারের তিনটি প্রধান কাজ ছিল: গত বছরের আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার, সাংবিধানিক ও আইনি সংস্কার, এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর। কিন্তু সরকারের ধীরগতি ও দায়িত্বহীনতার কারণে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে”। অর্থাৎ, ইউনুস তার নিজের কথাও রাখতে পারেননি। তিনি শুধু সময়ক্ষেপণ করেছেন, গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছেন।
আজ বাংলাদেশের মানুষ প্রশ্ন করছে—এই নির্বাচন কি তাদের জন্য? নাকি ইউনুসের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য? যখন প্রধান বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়, যখন গণমাধ্যমকে ভয়ে রাখা হয়, তখন সেই নির্বাচনের কোনো বৈধতা থাকে না। ইউনুস আজ বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিচ্ছেন। এবং এই নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য, সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়।