বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ওপর চলমান দমন-পীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
সংস্থাটি বলছে, ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন’-এর অপব্যবহার করে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে দমন করায় দেশের গণতন্ত্র চরম হুমকির মুখে পড়েছে। এতে মব সন্ত্রাস বেড়েছে। খুন জখম হচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা। তাদের সম্পত্তিও লুট করা হচ্ছে।
জুলাই সন্ত্রাসের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ক্ষমতায় বসা ইউনূস সরকার সংবিধান ও আইনের বাইরে গিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। ২০২৫ সালের ১২ই মে এক বিতর্কিত সংশোধনের মাধ্যমে ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন’কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে সাময়িক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দলটির সভা-সমাবেশ, প্রকাশনা এবং অনলাইন বক্তব্য—সবই নিষিদ্ধ করা হয়। প্রকাশ্যে নির্যাতন করা হচ্ছে দলটির নেতাকর্মীদের।
অন্তর্বর্তী সরকার দমনমূলক পথ যেন বেছে না নেয়, সে বিষয়ে সতর্ক করে এইচআরডব্লিউর এশিয়া বিভাগের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নামে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ কখনই মেনে নেওয়া যায় না।
সরকারবিরোধী তকমা দিয়ে এখন পর্যন্ত কয়েক লাখ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকেই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলার শিকার হচ্ছেন। বেশ কিছু গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি জানান, তারা চিকিৎসা পর্যন্ত পাচ্ছেন না—যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী।
একটি উদ্বেগজনক ঘটনার মধ্যে ২৮শে আগস্ট ‘মঞ্চ ৭১’-এর একটি শান্তিপূর্ণ আলোচনা সভা থেকে প্রখ্যাত সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেওয়া ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই হামলা চালায় একটি উগ্রপন্থি গোষ্ঠী, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং নিরীহ অংশগ্রহণকারীদেরকেই গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান ও আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে।
যদিও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন তারা কোনো ধরনের সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সাংবাদিক মনজুরুল আলম পান্নাকে যখন আদালতে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট ও হেলমেট পরিয়ে আনা হয়, তখন স্পষ্ট হয় এই দমননীতির ভয়াবহ রূপ।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কমপক্ষে ১৫২ জনকে মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার এই বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন—জেলে যাওয়া নাকি সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারানো।
এইচআরডব্লিউসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা মনে করছে, সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনকে রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও আজ হুমকির মুখে।
উল্লেখ্য, ২০২৫ সালের জুলাইয়ে জাতিসংঘ ও অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার বিষয়ে একটি ৩ বছরের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। অথচ বাস্তবতা হলো ইউনূস সরকারের এই সময়েই দেশে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন কখনোই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে ব্যবহৃত হওয়া উচিত নয়। সরকারের দায়িত্ব একটি নিরাপদ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়।
অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বিরোধী দলের ওপর চলমান দমন-পীড়নের কারণে সেই নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণমূলক হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকরা।
