জাকির তালুকদার
সাহিত্যের জগতে বহু বছরের বিচরণ। তাই অতীতের কে কেমন লিখতেন তা যেমন জানি, বর্তমানের কার লেখার কেমন মান তা-ও জানি।
৪০-৫০ বছর ধরে লিখেও অনেকেই লাইম লাইটে আসতে পারেননি। তাদের নিয়ে সদরে-মফস্বলে কোনো আড্ডায় কোনো আলোচনা হয় না। কারণ তারা নতুন চিন্তার বা নতুন ধারণার ও ধরনের কিছু লিখতে পারেননি।
তাই বলে তাদের কি কোনো মূল্য নেই? অবশ্যই আছে। বাংলাসাহিত্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার দায়িত্ব তারা পালন করে আসছেন।
আরেক ধরনের পাবলিকের কথা বলি। এত বছরের মধ্যে দেখেছি, হঠাৎ হঠাৎ হুজুগ তুলে ময়দান কাঁপাতে আবির্ভাব ঘটে কারো কারো। একমাস- দুইমাস- একবছর হই-হুল্লোড় করে কোনো বুদবুদ না তুলেই যথারীতি মিলিয়ে যায় তারা। প্রথম প্রথম মনে হয় তারা কেড়ে নিয়েছে মিডিয়ার সব মনোযোগ। কিন্তু এক বছর পরে মিডিয়া এবং সাহিত্যের লোকেরাও ভুলে যায় তার নাম।
চব্বিশের জুলাইয়ের পর স্পষ্টতই একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খানের ভাবশিষ্য, সাম্প্রদায়িক ঘরানার কিছু লিখিয়ে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও মিডিয়ায় আসন দখল করে বাংলাদেশের সাহিত্যের ধারাকে উল্টোদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের সাহিত্যের মূলধারা শুরু থেকেই অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী। কোনো ধর্মের ভিত্তিতে খণ্ডিত নয় আমাদের সাহিত্য। এই ধারা থেকেই জন্ম নিয়েছেন দেশের শ্রেষ্ঠ সব কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক। পাকিস্তান আমলের ২৩ বছর সরকারি সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে যারা পাক-বাংলার সাহিত্য সৃষ্টি করতে গেছেন, তাদের তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো লেখক-কবিরা।
পাকিস্তানের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া লেখক-কবিদের এই শোচনীয় পরাজয়ের কারণ কী? কারণ ভুল নীতি। সাহিত্য কখনো সাম্প্রদায়িকতা সহ্য করে না। সাম্প্রদায়িকতা একটি উৎকট দুর্গন্ধযুক্ত টিলা। সাহিত্যের স্রোত তাকে ভাগাড়ে নিক্ষেপ করে।
আর দ্বিতীয় শক্তি হচ্ছে প্রতিভা। মুক্তচিন্তার মানুষরা প্রকৃতিগতভাবেই বেশি প্রতিভাবান হন। তাদের চিন্তার বিস্তৃতি অনেক বেশি। নতুন নতুন দিকে তারা দৃষ্টি প্রসারিত করতে চান আমৃত্যু। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতার ধ্বজাধারীরা নিজেরাই নিজেদের চিন্তার চারপাশে নিষেধের বেড়া নির্মাণ করে অবিরাম। তাই তারা পরিণত হয় অন্ধ দুর্গের বাসিন্দাতে। তাদের হাতে যুগোত্তীর্ণ দূরের কথা, মোটামুটি মানসম্মত কিছুও সৃষ্টি হয় না।
আর সরকারের পদলেহীরা কখনোই ভালো কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। গত আওয়ামী রেজিমেও দেখা গেছে মুখে মুখে চেতনাধারী লেখক-কবিরা মূল্যবান কিছুই সৃষ্টি করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু এবং হাসিনা-বন্দনায় কাটিয়ে দিয়েছেন ১৫ বছর। উৎপাদন করেছেন হাজার হাজার ট্র্যাশ।
বর্তমানে যারা বাংলাদেশের সাহিত্যের মূলধারাকে প্রতিহত করার জন্য একত্রিত হয়েছেন, তাদের লেখার হ্যাডম নেই। সংকীর্ণ দৃষ্টির কারণে তারা নিজেদের লেখার দুর্বলতা খুঁজে বের করতে সক্ষম নন। সর্বোপরি আবর্জনা-নিষ্কাশনের যে অন্তর্নিহিত শক্তি সাহিত্যের নিজেরই রয়েছে, সেই শক্তিই তাদের আবার যথাযোগ্য স্থানে নিক্ষেপ করবে, ইতিহাস থেকে সেই শিক্ষাটিও তারা নিতে পারেননি।
