ড. লুবনা ফেরদৌসী
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত সংগ্রহ, যেগুলো একসময় বাংলা একাডেমিকে দেওয়া হয়েছিল জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবে, আজ সেগুলো নীলক্ষেতের ফুটপাথে কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাহ্, বেশ বেশ, একাডেমি এখন আর শুধু জ্ঞান না, স্মৃতিও বাটখারাতে বিক্রি করে।
Just silly ‘স্টোররুম খালি করার উদ্যোগ’ এর আড়ালে কি নিপুণ রাষ্ট্রীয় স্মৃতি-নিধন প্রকল্প, একধরনের bureaucratic epistemicide, জ্ঞানের প্রশাসনিক খুন, কাগজে-কলমে ‘মার্জিন অব এরর’।
ইমতিয়াজ মাহমুদের ভাষায়, এই কাজটি “ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছ থেকে আমাদের সংরক্ষিত স্মৃতি মুছে ফেলার” পরিকল্পিত প্রয়াস।তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলা একাডেমি যদি সত্যিই বই বিক্রির প্রয়োজন অনুভব করত, তবে কেন তা আড়ালে, গোপনে, কেজি দরে করা হলো? কেন প্রকাশ্য অকশন নয়, কেন পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ নয়? তিনি তীব্রভাবে বলেছেন,”এই বইগুলো কেবল বই নয়, ওগুলো আম্মার স্মৃতি। এই স্মৃতি নষ্ট করা মানে বাংলার ইতিহাসকে আঘাত করা।”
আমি আমার প্রফেশনের জায়গা থেকে, একজন দেশপ্রেমিক, এবং একজন নারীবাদী হিসেবে কয়েকটা বিষয় তুলে ধরতে চাই ,
প্রথমত, আইনগতভাবে বাংলা একাডেমি একটি সাংবিধানিক স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান, Bangla Academy Ordinance, 1978 অনুযায়ী যার মূল দায়িত্ব হলো “বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ, সংরক্ষণ ও প্রচার।” এই দায়িত্ব একাডেমি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের trustee guardian হিসেবে কাজ করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
জাহানারা ইমামের পরিবার যখন তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ বাংলা একাডেমিকে হস্তান্তর করেছিল, তখন সেটি কার্যত হয়ে যায় রাষ্ট্রীয় trust property, অর্থাৎ জনগণের সম্পদ, রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষণের জন্য প্রদত্ত। এই সম্পদ বিক্রি করা, তা সে ‘ডুপ্লিকেট’ বা ‘বাতিলযোগ্য’ যাই বলা হোক, আইন ও নৈতিকতার বিচারে এক fiduciary breach, অর্থাৎ আস্থাভঙ্গের অপরাধ।
দ্বিতীয়ত, ‘ডুপ্লিকেট কপি’ যুক্তি নৈতিকভাবে সম্পূর্ণ অসংগত। জাহানারা ইমামের সংগ্রহ ছিল annotated, অর্থাৎ হাতে লেখা টীকা, উৎসর্গ, সময়-নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক চিহ্নে পরিপূর্ণ। এমন দলিলগুলো material evidence of intellectual history। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত গ্রন্থ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সংগ্রহ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর পাণ্ডুলিপি, সবই সংরক্ষিত আছে রাষ্ট্রীয় আর্কাইভে এই কারণেই।
বাংলা একাডেমি যদি এই দলিলগুলোকে অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা করে, তাহলে সেটা প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং সাংস্কৃতিক অপরাধ।
তৃতীয়ত, একাডেমির মহাপরিচালকের বক্তব্য, “দোতলার কক্ষ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল, তাই বিক্রি”, রাষ্ট্রীয় অজ্ঞতার প্রতীক।সংরক্ষণাগার কোনো স্টোররুম নয়, এটা জাতির বৌদ্ধিক স্মৃতি সংরক্ষণের নৈতিক অবকাঠামো। আজ যদি শহীদ জননীর সংগ্রহ ‘জায়গা না থাকার’ কারণে বিক্রি হয়, কাল জাতীয় আর্কাইভও ‘জায়গা না থাকার’ যুক্তিতে ইতিহাসের দলিল বিক্রি করবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
চতুর্থত, এই ঘটনার সাংস্কৃতিক তাৎপর্য অনস্বীকার্য।
শহীদুল্লা কায়সারের স্বাক্ষরিত সংশপ্তক, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, রুমি ইমামের নোটযুক্ত Freedom Versus Organization, এসব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম ও ব্যক্তিগত ইতিহাসের স্পন্দিত দলিল।
আজ এগুলোর বাজারদর এক লাখ টাকা পর্যন্ত উঠেছে, যেটা প্রমাণ করে, বাজার জানে সাংস্কৃতিক মূল্য, কিন্তু রাষ্ট্র জানে না।রাষ্ট্র নিজেই নিজের ইতিহাসকে নিলামে তুলেছে, অজ্ঞতায়, অবমাননায়, আত্মবিস্মৃতিতে।
পঞ্চমত, এটা public accountability crisis। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক বলেছেন, ২০১৪ সালের কমিটি ‘বাতিলযোগ্য বই’ নির্ধারণ করেছিল। প্রশ্ন হলো,
কোনো প্রশাসনিক কমিটি কীভাবে একটি সাংস্কৃতিক সংগ্রহের curatorial authority পায়?
কোথায় সেই কমিটির কার্যবিবরণী, কোথায় সংরক্ষণনীতির দলিল, কোথায় provenance রেকর্ড?
এই নথির অনুপস্থিতিই প্রমাণ করে বাংলা একাডেমি এখন আর কোনো বৌদ্ধিক প্রতিষ্ঠান না, এটা হয়ে গেছে এক কাগজের অফিস, যেখানে জ্ঞানের দাম মাপা হয় কেজি দরে।
ষষ্ঠত, এই ঘটনার রাজনৈতিক তাৎপর্যও গভীর। জাহানারা ইমাম ছিলেন রাষ্ট্রীয় ভণ্ডামির বিরুদ্ধে নৈতিক প্রতিরোধের প্রতীক। তাঁর সংগ্রহ বিক্রি হওয়া একটা প্রতীকী প্রতিশোধ, রাষ্ট্রের স্মৃতিবিরোধী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। ইমতিয়াজ মাহমুদের ভাষায়, “ওরা একাত্তরকে ভয় পেয়ে এই কাজ করেছে”, একাত্তরের নৈতিক উত্তরাধিকার মুছে দিতে চায় এমন মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় এই ধরনের অবহেলা।
স্মৃতি সংরক্ষণ যেমন ইতিহাসচর্চার শর্ত, তেমনি এটা নৈতিক নাগরিকতারও শর্ত। রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বের প্রশ্নও এটা।
১৯৭১ এর বিচার যেমন রাষ্ট্রের নৈতিক অঙ্গীকার, তেমনি ১৯৭১ এর স্মৃতিধারক নাগরিকদের উত্তরাধিকার রক্ষা করাও সেই অঙ্গীকারেরই অংশ। বাংলা একাডেমি সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, আইনি, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক তিন মাত্রাতেই।
এখানে দাবি স্পষ্ট,
১. একটি স্বাধীন provenance audit হোক: বিক্রি হওয়া প্রতিটি বইয়ের নাম, বিক্রয়মূল্য, ক্রেতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া প্রকাশ করা হোক।
২. পরিবারের সম্মতি ও জনসম্পৃক্ত পুনঃতদন্ত শুরু করা হোক।
৩. দোষী প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে fiduciary breach ও trust violationএর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
৪. ভবিষ্যতের জন্য বাংলা একাডেমির collection policy ও archival ethics জনসমক্ষে প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হোক।
বাংলা একাডেমি হয়তো কেজি দরে বই বিক্রি করেছে। কিন্তু আসলে তারা বিক্রি করেছে, জাতির স্মৃতি, বুদ্ধিবৃত্তিক দায়বদ্ধতা, এবং এক প্রজন্মের নৈতিক
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, ইংল্যান্ড
