আফজাল হোসেন
শহরের মানুষ অনেকেই হয়তো “ভাগাড়” কাকে বলে চিনবে না। গ্রামের মানুষেরা জানে “ভাগাড়” হচ্ছে জনশূণ্য, পতিত একটা জায়গা। যেখানে প্রানী, পশুদের মরদেহ ফেলে রেখে আসা হয়।
সেখানে পশুদের হাঁড় গোড় পড়ে থাকতে দেখা যায়, দূর্গন্ধে বাতাস থাকে একটু ভারী। আশেপাশে বড় ছোট গাছ থাকলে, গাছগুলোয় তেমন পাতা থাকে না। যখন ভাগাড়ে নতুন কোনো পশুর মরদেহ না থাকে, সেই প্রায় শুকনো গাছগুলোতে কিছু বড় আকৃতির, বিদঘুটে লম্বা গলার প্রানী বসে বসে ঝিমায়।
এই পাখি গোত্রীয় প্রানীদের নাম শকুন। জগতের মধ্যে এদের জগতটাই আলাদা। জীবিতের প্রতি এদের কোনো আগ্রহ নেই। শুধু মৃতদেহ পছন্দ এদের। শকুনদের প্রিয় খাদ্য হচ্ছে মৃত, নির্জিব পশু। ভাগাড়ে নতুন খাদ্য এলে দূর-দূরান্তে থাকা শকুনেরা খবর পেয়ে যায় এবং মনে উৎসবের আনন্দ নিয়ে মৃত পশুটিকে ঠুকরে ঠুকরে, ছিঁড়ে খেতে চলে আসে।
পাখিকূলে সকল পাখিই সুন্দর। শকুন ব্যতিক্রম। এমনই হওয়ার কথা। যাদের কাজই হচ্ছে মৃতকে ছিঁড়ে খাওয়া, তারা ময়ূরের মতো পেখমঅলা হলে কেমন দেখাতো! তবে শকুনদের মন্দ ভাবা ঠিক নয়। তাদের চরিত্র, ভাগ্য যেমন লেখা হয়েছে, তাদের তেমনই হওয়া ছাড়া উপায় কী?
শকুনেরা মানুষ নয়। মানুষের মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা, চালাকির যোগ্যতা নেই তাদের। মানুষের মতো সহজেই তারা ভাব স্বভাব বদলে ফেলতে পারে না। শকুনদের বলে পাঠানো হয়েছে, জগতে তোমাদের কাজ, মরা পশুদের খাওয়া। খবরদার জীবিতদের দিকে তাকাবে না, লোভ করবে না।
শকুনেরা মরা, পঁচা খেয়ে বেঁচে থাকে। তারা অসুন্দর কিন্তু বেয়াড়া নয়, অবাধ্য নয়। জগতে যা করতে বলা হয়েছে, তেমনই করে জীবন কাটিয়ে দেয়।
তাদের লেখাপড়া করার সুযোগ নেই। নেই তাদের মধ্যে ধর্মভেদ। রাজনীতি নেই বলে তারা মৃত পশুকে খেতে এসে আমরা তোমরা করে না।
খাওয়ার উৎসবে তারা রাগারাগি করে কিন্তু ভাগাভাগি করে না। তাদের মাথায় মানুষের বুদ্ধি থাকলে তারা দল পাকিয়ে ফেলতো। দল হলে নেতাও হয়ে যেতো দু দশটা শকুন। তারপর দলের জোর অনুযায়ী কেউ হয়তো বলতো, আমাদের চাই পিছনের দিকটা।
সে দাবী শুনে আর এক দল যুক্তি হাজির করে বলতো, আমরা আগে খবর পেয়ে এখানে এসে হাজির হয়েছি, তাই পেট সহ পিছনের পা দুটোয় অধিকার আমাদেরই।
হয়তো তখন মৃত পশুটির কান ছিঁড়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে এক বৃদ্ধ শকুন। কলহ শুরুর সে মুহূর্তে কান ছেঁড়ার চেষ্টা থামিয়ে বয়স্ক শকুননেতা বলে ফেলতো, তোমরা মানুষদের মতো আচরণ করছো কেনো হে? আমরা বুড়ো, আমরাই প্রাচীন, অতএব পেটের পুরো অংশটায় আমাদের ন্যায্য অধিকার।
শকুনেরা মানুষের উদাহরণ দিতে পারে না। সেভাবেই তারা সৃষ্টি। মানুষ জগতশ্রেষ্ঠ। তারা সব পারে। তারা বিশেষ জ্ঞান বুদ্ধি সম্পন্ন বলে গৌরব করে। মানুষকে শকুন বা মন্দ কিছুর সাথে তুলনা করলে অগৌরবের, অপমানিতবোধ করে।
কাউকে অপমান, অমর্যাদা করো না- মানুষের জন্য এরকম নিয়ম বেঁধে দেয়া। মানুষ অপমানিত হতে চায় না কিন্তু অন্যকে সবচেয়ে উচ্চতর পর্যায়ে অপমান, অমর্যাদা কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে খুব করে ভাবে।
মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া আছে- কাউকেও ন্যায্য অধিকার থেকে বন্চিত করবে না। উচিৎ কথা বলো, চলো সত্য পথে। অন্যের জন্য উপকারি হও। সবসময় সকলরকম মন্দ থেকে দূরে থাকো।
মানুষ তো মানুষই। যা যা করণীয়, সবকিছুর উল্টো করে ও বলে তারা খুশি হয়। অন্যের ক্ষতি হোক, দেশ ভাগাড়ে পরিণত হোক বা পৃথিবী যাকগে রসাতলে- মানুষের তাতে কিছুই যায় আসে না। নিজ স্বার্থ রক্ষায় যা করা দরকার, তা- ই করা দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে ভাবে।
মানুষদের কপাল ভালো, শকুনদের অন্তর্দৃষ্টি নেই। যদি থাকতো, জীবিতের মতো চলে ফিরে বেড়ানো অনেক মানুষ যে আসলেই মৃত তা বুঝে ফেলতো তারা।
শকুনদের অন্তর্দৃষ্টি নেই বলে মরে গিয়ে জীবিত থাকা মানুষেরা দেশ ও দুনিয়া জুড়ে যা খুশি তা করে চলেছে, করে বেড়াতে পারছে।
