ড. মামুনুর রশীদ
সরল বাক্যে বন্দর ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় দুনিয়ার দরবারে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবেশদ্বার। এশিয়ার উন্নয়ন, দক্ষিণের সামুদ্রিক সম্পদ এবং বিশ্বের সাথে আমাদের সম্পর্কের অন্যতম প্রধান মাপকাঠি বন্দরের বহুমুখীকরণ এবং উন্নয়ন।
এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে তোলা হয়েছিলো কর্ণফুলী টানেল, কক্সবাজার বিমানবন্দর, মীরসরাই জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল, এবং দক্ষিণের সাথে রেল যোগাযোগ।
এখন সব শেষ।
বন্দর দিয়ে দেয়া হয়েছে বিদেশীদের কাছে। এমন না যে আমাদের বন্দর লোকসানে ছিলো। জুলাই-আগস্টের পট পরিবর্তনের পর নিজেদের সম্পদ আর নিজের করে রাখা গেলোনা।
যাদেরকে বিশ্বাস করে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তারাই নিজেদের মাথা বাঁচানোর জন্য বিক্রি করে দিলো দেশের হৃৎপিন্ড। কাউকে জিগেস করার প্রয়োজন মনে করেনি তারা। এরা তারাই যারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিথ্যাচার করেছে বৈদেশিক সম্পর্ক নিয়ে। অথচ এই ছিলো তাদের মিথ্যার আড়ালের মূল সত্য।
বন্দর ব্যবস্থাপনা
সমুদ্র বন্দর কৌশল এবং অর্থনৈতিক কারণে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে মোটাদাগে চার ধরনের বন্দর ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু আছে।
১) বন্দর কর্তৃপক্ষ – বিভিন্ন দেশে বন্দরের স্বতন্ত্রতা রক্ষার স্বার্থে বন্দরের জন্য আলাদা অথরিটি বা কর্তৃপক্ষ তৈরি করে। নিজস্ব কন্ট্রোল থাকলেও দিন শেষে নাটাই থাকে দেশের সরকারের হাতে। সিঙ্গাপুর বন্দরের পিএসএ (পোর্ট অফ সিঙ্গাপুর অথরিটি) একটি উদাহরণ হতে পারে।
২) অপারেটর – বন্দর কর্তৃপক্ষ যখন অন্যদেশের কোনো কোম্পানি হয় সেক্ষেত্রে একটা সময়ের জন্য এই কোম্পানি বন্দরের দায়িত্ব নেয়। বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব থাকলে সাধারণত এই ধরনের অপারেটর মডেলে বন্দর পরিচালনা হয়না। এর উদাহরণ হতে পারে কস্কো, মার্স্ক এর এপিএম টার্মিনাল কিংবা ডিপি ওয়ার্ল্ড।
৩) সরাসরি দেশীয় কিংবা সরকারি কোম্পানির মাধ্যমে বন্দর ব্যবস্থাপনা – বিশ্বের বেশিরভাগ বড় বন্দর এই পদ্ধতিতে চলে। চীনের বড় সব বন্দর চলে নিজেদের সরকারি ব্যবস্থাপনায়।
৪) হাইব্রিড – উপরের এক বা একাধিক পদ্ধতিকে কিছুটা পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে বন্দর ব্যবস্থাপনা করা হয়। জেবেল আলী (সংযুক্ত আরব আমিরাত)-এর মতো বন্দরগুলি একটি সাধারণ আধুনিক মডেল দেখায় যেখানে একটি সরকার-মালিকানাধীন কর্পোরেশন একটি বেসরকারি, লাভ-অর্জনকারী বৈশ্বিক ব্যবসার মতো কাজ করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের কাছে জবাবদিহি করে।
বিশ্বের বড় ১৫টি বন্দরের পরিচালন ব্যবস্থা
আমাদের বলা হয়েছে বন্দর বিদেশীদের দিলে দেশ বিদেশ হয়ে যাবে। অথচ নিচে দেখুন বিশ্বের বড় বেশিরভাগ বন্দর চলছে ওই দেশের সরকারি কোম্পানির মালিকানায়।
১. শাংহাই বন্দর, চীন
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ৪৯.১ মিলিয়ন TEU (টুয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট)
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: শাংহাই ইন্টারন্যাশনাল পোর্ট গ্রুপ (এসআইপিজি) – একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান।
শাংহাই বন্দর টানা কয়েক বছর ধরে বিশ্বের ব্যস্ততম কন্টেইনার বন্দরের অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০২৩ সালে এর ট্র্যাফিক আগের বছরের তুলনায় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিশ্ব বাণিজ্যে এর অগ্রগণ্য ভূমিকাকে নির্দেশ করে।
২. সিঙ্গাপুর বন্দর, সিঙ্গাপুর
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ৩৯.০ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: সিঙ্গাপুরের সামুদ্রিক ও বন্দর কর্তৃপক্ষ (এমপিএ) – একটি সরকারি সংস্থা।
বৈশ্বিক বাণিজ্যে চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সিঙ্গাপুর বন্দর ২০২৩ সালে তার ট্র্যাফিক স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছে। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রধান ট্রানশিপমেন্ট হাব হিসেবে তার কেন্দ্রীয় ভূমিকা বজায় রেখেছে।
৩. নিংবো-ঝৌশান বন্দর, চীন
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ৩৫.৩ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: নিংবো ঝৌশান পোর্ট গ্রুপ – একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কনগ্লোমারেট।
চীনের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত এই বন্দরটি দেশের শিল্প ও উৎপাদন ক্ষেত্রের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গেটওয়ে। এর কন্টেইনার ট্র্যাফিকের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
৪. শেনঝেন বন্দর, চীন
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ২৯.৮ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: শেনঝেন পৌর পরিবহন ব্যুরো ও বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সহায়ক সংস্থা।
শেনঝেন বন্দর আসলে ইয়ানতিয়ান এবং শেকোউ সহ কয়েকটি বন্দরের সমন্বয়। এটি চীনের প্রযুক্তি শিল্পের কেন্দ্রস্থল এবং পিয়ার রিভার ডেল্টা অঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর।
৫. গুয়াংঝু বন্দর, চীন
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ২২.৬ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: গুয়াংঝু পোর্ট গ্রুপ কো., লিমিটেড – একটি রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ।
গুয়াংঝু বন্দর দক্ষিণ চীনের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর, বিশেষ করে শিল্প-সমৃদ্ধ গুয়াংডং প্রদেশে। এটি একটি বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চলের সমুদ্রগেটওয়ে।
৬. কিংদাও বন্দর, চীন
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ২১.৮ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: শানদং পোর্ট গ্রুপ – একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কনগ্লোমারেট।
কিংদাও বন্দর বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল বন্দর হিসেবে পরিচিত। এটি উত্তর-পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এবং এর ট্র্যাফিক ভলিউম অত্যন্ত শক্তিশালী।
৭. তিয়ানজিন বন্দর, চীন
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ২১.৮ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: তিয়ানজিন পোর্ট (গ্রুপ) কো., লিমিটেড – একটি রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ।
এই বন্দরটি বেইজিং এবং উত্তর চীনের বিশাল শিল্পাঞ্চলের জন্য সমুদ্রগেটওয়ের কাজ করে। এটি উত্তর চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলির মধ্যে একটি।
৮. বুসান বন্দর, দক্ষিণ কোরিয়া
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ২২.৯ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: বুসান পোর্ট অথরিটি (বিপিএ) – একটি সরকারি সংস্থা।
বুসান বন্দর শুধু দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহত্তম বন্দরই নয়, এটি সমগ্র উত্তর-পূর্ব এশিয়ার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ট্রানশিপমেন্ট হাব।
৯. হংকং বন্দর, হংকং (চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল)
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ১৪.৪ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: হংকং বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল সরকারের মেরিন ডিপার্টমেন্ট।
হংকং বন্দর ঐতিহ্যগতভাবে একটি শীর্ষস্থানীয় বন্দর ছিল, কিন্তু আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার কারণে এর ট্র্যাফিক ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। তবুও এটি একটি প্রধান বৈশ্বিক বন্দর হিসেবে পরিচিত।
১০. রটারডাম বন্দর, নেদারল্যান্ডস
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ১৩.৪ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: পোর্ট অফ রটারডাম অথরিটি (রটারডাম পৌরসভা ও ডাচ সরকারের যৌথ উদ্যোগ)।
রটারডাম বন্দর ইউরোপের বৃহত্তম বন্দর এবং পুরো মহাদেশের জন্য একটি প্রধান প্রবেশদ্বার। যদিও ২০২৩ সালে বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে এর ট্র্যাফিক কিছুটা কমেছিল।
১১. জেবেল আলী বন্দর, সংযুক্ত আরব আমিরাত
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ১৪.০ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: ডিপি ওয়ার্ল্ড (দুবাই সরকারের majority মালিকানাধীন)।
জেবেল আলী বন্দর কেবল মধ্য প্রাচ্যের বৃহত্তম বন্দরই নয়, এটি একটি বিশাল বৈশ্বিক লজিস্টিকস ও বাণিজ্যিক হাব। এটি বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিস্থল।
১২. পোর্ট ক্লাং, মালয়েশিয়া
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ১৩.৯ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: মালয়েশিয়া বন্দর কর্তৃপক্ষ।
মালাক্কা প্রণালীতে অবস্থিত পোর্ট ক্লাং হল মালয়েশিয়ার প্রধান বন্দর। এটি একটি বড় ট্রানশিপমেন্ট সেন্টার এবং সিঙ্গাপুর বন্দরের জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিযোগী।
১৩. তানজং পেলেপাস বন্দর, মালয়েশিয়া
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ১০.৮ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: জোহর পোর্ট অথরিটি – একটি সরকারি সংস্থা।
তানজং পেলেপাস হল মালয়েশিয়ার আরেকটি প্রধান বন্দর এবং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ট্রানশিপমেন্ট সেন্টার, যা আন্তর্জাতিক Shipping রুটগুলিতে তার কৌশলগত অবস্থানের সুবিধা নেয়।
১৪. লস অ্যাঞ্জেলেস বন্দর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ৮.৬ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: লস অ্যাঞ্জেলেস শহর (লস অ্যাঞ্জেলেস হারবার ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে)।
লস অ্যাঞ্জেলেস বন্দর হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের সবচেয়ে বড় বন্দর। মহামারী পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার জটিলতার পর ২০২৩ সালে এর ট্র্যাফিক স্বাভাবিক স্তরে ফিরে আসে।
১৫. হামবুর্গ বন্দর, জার্মানি
কন্টেইনার ট্র্যাফিক (২০২৩): ৭.৭ মিলিয়ন TEU
পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ: হামবুর্গ পোর্ট অথরিটি (এইচপিএ) – হামবুর্গ শহরের মালিকানাধীন।
হামবুর্গ বন্দর জার্মানির বৃহত্তম বন্দর এবং “ইউরোপের উত্তর দরজা” নামে পরিচিত। তবে, ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য হ্রাস পাওয়ায় বন্দরটির ট্র্যাফিক কিছুটা প্রভাবিত হয়েছে।
উপরের বিশ্লেষণ থেকে সহজে যা বুঝতে পারছেন:
১) বেশিরভাগ সমুদ্রবন্দর দেশগুলো তাদের নিজেদের কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত করে।
২) কিছু ক্ষেত্রে সরকারি কোম্পানির সাথে বিদেশি কোম্পানির সমন্বয় করে চলে তবে কোনোভাবেই দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নয়।
… আর ইউনূস দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সম্পদ বিক্রি করে দিলো জনগণকে কিছু না জানিয়ে।
পরিচিতি: ড. মামুনুর রশীদ, অর্থনীতিবিদ
