পারভেজ হাসেম
১৫ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক খতমে নবুয়ত মহাসম্মেলনে আবারও ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাংবিধানিক অধিকার ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা নিয়ে বিতর্ককে সামনে নিয়ে এসেছে। পাকিস্তান, ভারত, সৌদি আরব, মিশরসহ বিভিন্ন দেশের আলেমরা এতে অংশ নেন। বিএনপি ও জামায়াতসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনের মঞ্চ থেকে তাওহিদে খতমে নবুয়ত বাংলাদেশের আমীর আল্লামা মুফতি ড. সৈয়দ মুহাম্মদ এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী বলেন, মুসলমানদের “মূল দাবি” যদি সংবিধানে প্রতিফলিত না হয়, তবে তারা তা মেনে নেবে না। তিনি রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা করেন—কেন তারা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অ-মুসলিম ঘোষণা করতে দ্বিধা করছে। কয়েকজন বক্তাও একই দাবি করেন এবং বলেন, আহমদিয়াদের আনুষ্ঠানিকভাবে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং তাদের ইসলামি পরিভাষা ব্যবহার করতে দেয়া যাবে না।
এ ধরনের দাবি ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমান নাগরিক অধিকারের মূল নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিশ্বাস ব্যক্তিগত বিষয়, এবং কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কারও ওপর পরিচয় চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার নেই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো—সব নাগরিক যেন মর্যাদা, সমতা ও নিরাপত্তার সঙ্গে বাঁচতে পারে তা নিশ্চিত করা।
এ বছরের সম্মেলনে যেটি বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তা হলো—বিদেশি আলেমদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। তারা প্রকাশ্যে আহমদিয়া মুসলিম পরিচয় বাতিলের পক্ষে কথা বলেছেন।
সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, পাকিস্তানের মাওলানা ফজলুর রহমান প্রধান অতিথি ছিলেন। আরও ছিলেন মাওলানা ইলিয়াস ঘুমান, মাওলানা হানিফ জলন্ধরী, আহমদ ইউসুফ বানুরি। ভারত থেকে মুফতি আবুল কাসেম নোমানি ও মাওলানা মাহমুদ মাদানিও আসেন। সৌদি আরব থেকে শেখ আব্দুর রউফ মাক্কি এবং মিশর থেকে শেখ মুসাব নাবিল ইব্রাহিম অংশ নেন।
তাদের উপস্থিতি ও বক্তব্য আইনি ও বাস্তবিক কিছু প্রশ্ন তোলে। বিদেশিরা বাংলাদেশে পর্যটন, ব্যবসা, সম্মেলন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা কাজের ভিসায় আসতে পারেন। প্রতিটি ভিসার নির্দিষ্ট শর্ত আছে। পর্যটন বা ব্যবসার ভিসায় ধর্মীয় বা রাজনৈতিক প্রচারণা চালানো যায় না। সম্মেলনের ভিসাতেও শুধু অনুমোদিত সভায় অংশ নেওয়ার অনুমতি থাকে। সংবেদনশীল ধর্মীয় বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা ভিসা শর্তভঙ্গ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
বাংলাদেশের আইনে কোনো ব্যক্তি—দেশি বা বিদেশি—কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীকে অমুসলিম ঘোষণা করতে পারে না। সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে উত্তেজনাকর বক্তব্য দিলে তা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি বা জনশৃঙ্খলা বিঘ্নের অপরাধের আওতায় পড়ে। বিদেশিরা এ ধরনের কাজ করলে ভিসা বাতিল, মামলা বা তৎক্ষণাৎ বহিষ্কারের মুখে পড়তে পারেন।
আরও বড় বিষয় হলো—জাতীয় দায়িত্ব। বাংলাদেশ এখন ধর্মীয় সংবেদনশীল এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি আলেমরা দেশের ভেতরের ধর্মীয় বিতর্কে হস্তক্ষেপ করলে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে। এতে উগ্রগোষ্ঠী উৎসাহিত হতে পারে এবং সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের নাজুক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিদেশি প্রভাব বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বিব্রত করতে পারে—বিশেষত যখন দেশটি বিনিয়োগবান্ধব ও স্থিতিশীল চিত্র তুলে ধরতে চায়।
আরও উদ্বেগজনক হলো—বাংলাদেশ সরকারের নীরবতা। উচ্চপ্রোফাইল বিদেশি আলেমদের উপস্থিতি এবং উত্তেজনাকর বক্তব্য সত্ত্বেও কোনো মন্ত্রণালয় বা সরকারি সংস্থা কোনো বিবৃতি দেয়নি। নিরাপত্তা বা বিদেশিদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার পক্ষ থেকেও কোনো ব্যাখ্যা আসেনি।
এই নীরবতা গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে রাষ্ট্রের অবস্থান অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। এতে মনে হতে পারে—সরকার এসব কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করছে বা ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোর চাপের সামনে দাঁড়াতে আগ্রহী নয়। সংবিধানের মূলনীতির একটি সাধারণ স্মরণও না থাকা—সংখ্যালঘুদের কাছে অবহেলা মনে হতে পারে, আর উগ্রগোষ্ঠীর কাছে এটা উৎসাহ হিসেবে ধরা দিতে পারে।
বিদেশি আলেমদের এমন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে অবাধে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়াও এ ধারণাকে শক্ত করে। বহু দেশে বিদেশিরা এমন মন্তব্য করলে সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে দৃশ্যমান পদক্ষেপ না থাকায় মনে হয় সংবেদনশীল ধর্মীয় বিষয়গুলো উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।
এ ধরনের নীরবতা বৈচিত্র্যময় ও আবেগপ্রবণ সমাজ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। রাষ্ট্র যখন সমান অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নীতি দৃঢ়ভাবে রক্ষা না করে, তখন বর্জনমূলক শক্তিগুলো আরও সাহস পায় এবং সংখ্যালঘুরা আরও অসহায় হয়ে পড়ে।
সরকার যেহেতু স্থিতিশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলে থাকে, তাই একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার হুমকির মুখে পড়লে সেটিকে উপেক্ষা করা নিরপেক্ষতা হিসেবে ধরা যায় না। সরকারি নিষ্ক্রিয়তা সহজেই সমর্থন হিসেবে ব্যাখ্যা হতে পারে।
এ মুহূর্তে দায়িত্বশীল নেতৃত্ব দরকার। বাংলাদেশকে স্পষ্ট করে জানাতে হবে—রাষ্ট্র কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। এমন সংবেদনশীল বিষয়ে নীরবতা বিভ্রান্তি বাড়ায় এবং মানুষের সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে আস্থা দুর্বল করে। রাষ্ট্রকে ঠিক করতে হবে—সে সমঅধিকারের পক্ষে থাকবে, নাকি বিভাজন তৈরির চেষ্টাকারীদের পাশে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশ এখন সুযোগ পেয়েছে আবারও ঘোষণা করার—দেশি বা বিদেশি কেউই তার নাগরিকদের ওপর ধর্মীয় পরিচয় চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার রাখে না। যখন অন্তর্বর্তী সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের মূলনীতিগুলো থেকে সরে গেছে বলে বহু মানুষ মনে করে, তখন এমন স্পষ্ট বক্তব্য আরও জরুরি। এটি শুধু সাংবিধানিক দায়িত্ব নয়, বরং জাতির নৈতিক শক্তিরও প্রমাণ—যা ধর্মীয় মৌলবাদের সামনে নত না হওয়ার বার্তা দেয়।
পরিচিতি: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী
