জুলাইয়ের রক্তাক্ত দাঙ্গার পর যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাদের সরকারি ক্রয়ের ধরনটা দেখলে মনে হয় সিঙ্গাপুর ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো দেশ নেই। গম কিনতে হলে সিঙ্গাপুর, চাল কিনতে হলে সিঙ্গাপুর, এলএনজি কিনতে হলে সিঙ্গাপুর। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সিঙ্গাপুর নিজে এসবের কিছুই উৎপাদন করে না। তারপরও বাংলাদেশ সরকারের যাবতীয় বড় ক্রয় যেন সিঙ্গাপুরমুখী হয়ে গেছে।
এই পুরো ব্যাপারটার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন একজন বিশেষ দূত, যিনি উপদেষ্টা পদমর্যাদার। সিঙ্গাপুরের র্যাফলস প্লেসে তাকে নিয়মিত দেখা যায়। তার স্ত্রী সিঙ্গাপুরিয়ান, তিনি নিজে সিঙ্গাপুরে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন, সেখানে পড়িয়েছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কাজ করেছেন। এসব তো তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু সমস্যা হলো যখন এই ব্যক্তিগত সংযোগ সরকারি সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম কিনলেন সরকার। কিন্তু টাকা যাবে সিঙ্গাপুরে। যুক্তরাষ্ট্রের গম সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে কেনায় প্রতি টনে বাড়তি খরচ হচ্ছে ৩৩ ডলার। কয়েক মাস আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোম্পানি থেকে যে গম কিনেছিল সরকার, তার দাম ছিল টনপ্রতি ২৭৫ ডলার। আর এখন সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে কিনতে গিয়ে দাম পড়ছে ৩০৮ ডলার। এই অতিরিক্ত খরচের কোনো যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা নেই।
ভারত থেকে চাল আসছে, কিন্তু সরবরাহকারী সিঙ্গাপুরের। অর্থ উপদেষ্টা নিজেই এটা স্বীকার করেছেন। প্রশ্ন হলো, যে দেশ থেকে পণ্য আসছে, সরাসরি সেই দেশ থেকে কিনলে সমস্যা কী? মধ্যস্বত্বভোগীর এই ভূমিকা কার স্বার্থে? দুটো কার্গো এলএনজি কিনতে খরচ হচ্ছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি, আর সেটাও সিঙ্গাপুর থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের মোট বাণিজ্য ছিল ৩২৩ কোটি ডলারের বেশি, যার ৩০৫ কোটি ডলারই আমদানি বাবদ খরচ। এই বিশাল অঙ্কের টাকা সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর জনগণ জানতে চায়।
যে সরকার সংস্কারের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের এই ক্রয়নীতি কতটা স্বচ্ছ? বিশেষ দূতের এই একচ্ছত্র প্রভাব কি ক্ষমতার অপব্যবহার নয়? সরকারি সূত্রগুলো বলছে, এই বিশেষ দূত শুধু ক্রয়ই নয়, বন্দর বিষয়ে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিতেও ভূমিকা রেখেছেন। প্রশাসনের ভেতরে তার অবস্থান এতটাই শক্তিশালী যে, প্রতিটি বড় সিদ্ধান্তে তার মতামত চূড়ান্ত বলে মনে করা হয়।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মহলের অনেক অন্যায্য দাবি এই সরকার মেনে নিয়েছে, যা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, সরকারি ক্রয়ে বিশেষ দূতের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারবেন না, তবে আন্তর্জাতিক মহলের নানা দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করা হয়নি। এটা ভবিষ্যতে সংকট তৈরি করতে পারে।
আরেকটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিঙ্গাপুর এখন বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের একটা প্রধান গন্তব্য। বিভিন্ন সরকারি তদন্তেও এটা উঠে আসছে। অনেক ব্যবসায়ীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, প্রাইভেট ফান্ড আর সেকেন্ড হোম সিঙ্গাপুরে আছে। অফশোর কোম্পানি খোলা আর রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগ সিঙ্গাপুরে সহজ বলে অনেকে সেই পথ বেছে নেন। এই পরিস্থিতিতে সরকারি ক্রয়ের পুরো প্রক্রিয়া সিঙ্গাপুরকেন্দ্রিক করে ফেলা কতটা যৌক্তিক?
যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা গমের টাকা সিঙ্গাপুরের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে জমা হবে। বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক সিঙ্গাপুরে এলসি খুলবে। পুরো প্রক্রিয়াটা এমনভাবে সাজানো যে, অর্থ প্রবাহের প্রতিটি ধাপে সিঙ্গাপুর আছে। এটা কি শুধু কাকতালীয়?
নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে যে অবৈধ সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল স্বচ্ছতার। কিন্তু এই ক্রয়কাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, স্বচ্ছতা নয়, বরং একটা নতুন ধরনের স্বজনপ্রীতি তৈরি হচ্ছে। যেখানে ব্যক্তিগত সংযোগ আর আঞ্চলিক পক্ষপাত সরকারি সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে।
জনগণের টাকায় চলে সরকার। সেই টাকা খরচের হিসাব দিতে হবে সরকারকে। কেন সিঙ্গাপুর? কেন বেশি দাম? কেন মধ্যস্বত্বভোগী? কেন একজন বিশেষ দূতের এত প্রভাব? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া জরুরি। নইলে সংস্কারের নামে যে সরকার এসেছে, তারাও আগের সরকারগুলোর মতোই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
দেশের অর্থনীতি যখন চাপে আছে, রিজার্ভ যখন কমছে, মূল্যস্ফীতি যখন সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে, তখন এই অপ্রয়োজনীয় খরচ দেশের জন্য আরও বড় বিপদ ডেকে আনছে। সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা না থাকলে দুর্নীতি বাড়ে, জনগণের আস্থা কমে। আর যখন দেখা যায় যে একজন ব্যক্তির ইচ্ছায় সবকিছু চলছে, তখন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে পড়ে।
সংস্কারের নামে যারা এসেছেন, তাদের কাছে প্রশ্ন একটাই : এই সিঙ্গাপুরফিলিয়ার কারণ কী? জনগণ জানতে চায়, কার স্বার্থে এই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। দেশের স্বার্থ নাকি ব্যক্তিবিশেষের সুবিধা? সময় এসেছে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার।
