– মৃণ্ময় সেন
২০২৫ এর ১০ই ডিসেম্বরে বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে কেমন ছিলো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি? মানবাধিকার কি শুধুমাত্র ধর্মিয় লেবাসধারী জঙ্গিদের, উগ্রবাদীদের জন্য নাকি রাজনৈতিক নেতাকর্মিদের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য?
এটি সরকার বিরোধীদের জন্য বেশী প্রযোজ্য নাকি এটি সকলের জন্য সমান—মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, আওয়ামী লীগের কর্মী বা ছাত্রলীগের সদস্যরাও মানবাধিকারের আওতাভুক্ত?
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের ছদ্মবেশে যেই উগ্রমৌলবাদ আর জঙ্গিদের সহয়তায় বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, আনসার বিজিবি’র উপর আক্রমন হয়েছে, সেটা প্রতিহত করা কি ছিল মানবতা বিরোধী অপরাধ?
নাকি ২০২৪ এর ৩রা আগস্ট থেকে অদ্যবধি হাজার হাজার মানুষের হত্যা, গুম, নির্যাতন—এই রক্তাক্ত অধ্যায়গুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে?
একদিকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষা’র বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র নিন্দা, অন্যদিকে প্রতিশোধের নামে সহিংসতা ও লাশের নগরীতে মানবাধিকার সংস্থা গুলোর বিষ্ময়কর নীরবতা। এই দ্বৈততার আলোকে যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন উঠছে: মানবাধিকার কি রাজনৈতিক পক্ষপাতের শিকার হয়ে গেছে?
জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় কোটা সংস্কারের দাবিতে, কিন্তু তা দ্রুত রূপ নেয় গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াইয়ে, তারপর সরকারের পতন আর রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রের প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ পদ দখলের এক উন্মত্ত খেলা।
২০২৪ এর জুলাইয়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ—পুলিশ, আনসার, রিজার্ভ ফোর্স—ছাত্র আনোলনকারীদের পেছনের সংঘবদ্ধ জঙ্গি ও উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করে রাষ্ট্র ও নির্বাচিত সরকার এবং সংবিধানকে রক্ষা করার শেষ চেষ্টা হিসবে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ আর রাষ্ট্রের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার দ্বৈরথে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্ট অনুসারে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে আন্দোলনকারী ছাত্র জনতা থেকে শুরু করে ৫ই আগস্টের সরকার পতনের পরেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মি সহ ১,৪০০-এর বেশি মানুষকে নিহত হয়, যার মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ শিশু।
যদিও জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং এর সাথে ইউনুস সরকার ও ছাত্র সমন্বয়কদের ২০০০ মানুষ হত্যার আকাশকুসুম দাবি শেষ পর্যন্ত জোড়াতালি দিয়ে ৮৩০ এ এসে দাঁড়ায়, যার মধ্যে পক্ষ বিপক্ষ সবাই আছে। যদিও বিভিন্ন যাচাই বাছাই এ অনেক জোচ্চুরি দেখা যাচ্ছে নিহতদের সরকারী তালিকায়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যে, পুলিশ লাইভ অ্যামুনিশন, রাবার বুলেট এবং টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা চালায়। এই সময়ে তথাকথিত শান্তিপূর্ন বিক্ষোভকারীদের আক্রমণে ৪৪ জন পুলিশ সদস্যও নিহত হন, যা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রিপোর্টের বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঠিক কতোজন সদস্যকে হত্যা করেছে তথাকথিত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীরা তার সঠিক সংখ্যা আজও প্রকাশ করার সাহস করে উঠতে পারে নাই নোবেল লরিয়েট আর বিদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষিতদের সরকার।
কিন্তু জুলাই২৪ আন্দোলনে যখন জামাত-ই-ইসলামী বা শিবিরের সশস্ত্র উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রতিরোধ করে, বা আক্রমণ দমনে পাল্টা হামলা চালায়, তখন মানবাধিকারের ফেরিওয়ালাদের কণ্ঠস্বরে মাতমের সুর ছিল। মাদ্রাসা ও স্কুল কলেজ থেকে আগত অপ্রাপ্তবয়স্ক বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করায় অথবা তৃতীয় পক্ষের দ্বারা রহস্যময় ৭.৬২ বুলেটের মাধ্যমে রাস্তায় নেমে আসা মানুষকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে হত্যা এই সব কিছু নিয়েই কথা বলেছে মানবতার ধারক বাহক দেশী ও বিদেশী ফেরিওয়ালারা।
এই সময়ে মানবাধিকারের ধারণা ছিল সকলের জন্য—পুলিশের জানজীবন রক্ষার পাশাপাশি বিক্ষোভকারীদের অধিকারের প্রতি সমান মনোযোগ ছিল মানবাধিকার সংস্থাগুলোর।
কিন্তু ২০২৪ এর ২-৩ আগস্ট থেকে পরিস্থিতি উলটে যায়। শেখ হাসিনার পতনের পর প্রতিশোধের নামে আওয়ামী লীগের হাজারো নেতা-কর্মীকে হত্যা, গুম বা নির্যাতন করা হয়। শুরু হয় সংস্কারের নামে মবোক্রেসি। লিস্ট করে করে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মিদের প্রতিটা বাড়ি লুট হয়, আগুন লাগানো হয় আর নেতাকর্মিদের পাওয়া গেলে সরাসরি হত্যা করা হয়।
গ্লোবাল সেন্টার ফর ডেমোক্র্যাটিক গভর্ন্যান্সের (জিসিডিজি) প্রিলিমিনারি রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগস্ট ২০২৪ থেকে মে ২০২৫ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ১২৩ জন কর্মীকে টার্গেট করে কিলিং মিশন চালানো হয়েছে, যার মধ্যে ৪১ জনকে তালিবানি ধারায় কুপিয়ে মারা হয়।
রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপের (আরআরএজি) তথ্যে, ৫ আগস্ট থেকে এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত ১২৩ আওয়ামী লীগ সদস্যকে টার্গেট করে হত্যা, যার মধ্যে শিশু, নারী এবং অক্ষম ব্যক্তিরাও ছিলেন।
গোপালগঞ্জ ম্যাসাকারে ৫ জন নিহত, নদীতে ভাসা লাশের সংখ্যা মাসে গড়ে ৪৩, জেলে নির্যাতনে ১১২ জনের মৃত্যু—এসব ঘটনার সাথে বিভিন্ন ঘটনা উঠে আসতে থাকে যা যে কোন নৃশংস মাফিয়া গ্যাং এর প্রতিপক্ষ দমনের প্ল্যানকে হার মানায়।
কোথাও ছাত্রলীগ কর্মিকে না পেয়ে নামাজরত মাকে কুপিয়ে হত্যা, যুবলীগনেতাকে ধরতে এসে ১৪ বছরের সন্তানকে অস্ত্র আইনে গ্রেপ্তার, দশমাসের শিশুর বাবার হাত কাটা, বছর ধরে জীবন বাচাতে পালিয়ে থাকা নেতাকর্মিরা বাবা-মা-স্ত্রী সন্তানের সাথে গোপনে দেখা করতে এসে নৃশংশভাবে হত্যার শিকার, সন্তানের ঔষধ কিনতে গিয়ে হত্যা, বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্টীফিকেট তুলোটে গিয়ে হত্যা আর মবের শিকার—কোথাও মানবাধিকারের বুলি শোনা যায়নি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ১,০০০-এর বেশি মামলায় দশ হাজারো আওয়ামী লীগ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চিহ্ন। সঠিক সংখ্যাটা হয়তো আরো বেশী, কারন কারাগারে রাজনোটিক বন্দি সংকুলান করতে না পেরে পুরানো অব্যাবহুত কারাগার গুলোকে চালু করা হচ্ছে। “আয়নাঘর” এর যেই কাল্পনিক গল্প শুনিয়ে ঘৃণিত নৃশংস এক চরিত্র বানিয়েছে শেখ হাসিনার, তারচেয়েও শতগুন বেশী স্বৈরতান্ত্রিক আর জুলুম নির্যাতনের প্রতীক হয়ে উঠেছে ড ইউনুসের সৃষ্ট “বাংলার গুয়ানতানামো কারাগার”
৫ই আগস্ট ২০২৪ পরবর্তি হাজারো ঘটনার খুব সামান্য অংশ মাত্র এগুলা। এখন জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কোথায়? কোথায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, কোথায় জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের (ওএইচসিএইচআর), কোথায় এমেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কোথায় মানবাধিকারের নামে গজিয়ে ওঠা শতশত ডিপস্টেট এজেন্সি?
মানবতার নামে কর্পোরেট ফান্ডিং এ গড়ে ওঠা এইসব মানবাধিকার সংস্থাগুলোর একচোখা নীতির কারনে প্রচলিত মানবিক অধিকারের সংজ্ঞাই যেন বদলে গেছে। জুলাইয়ের আগে, যখন জামাত-শিবিরের উগ্রবাদীরা পুলিশ আক্রমণ করে, তখন আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো সক্রিয়—ওএইচসিএইচআর, অ্যামনেস্টি, এইচআরডব্লিউ সবাই প্রতিবাদ করে। কিন্তু আগস্টের পর, যখন মুক্তিযুদ্ধাদের পরিবার পরিজন ও আওয়ামী লীগের লাখো নেতা-কর্মি-সমার্থককে লক্ষ্য করে টার্গেট কিলিং চলে, মব করা হয়, সহিংসতা চলে, দখল চলে, চাঁদাবাজি আর মামলাবাণিজ্য চলে তখন তারা নীরবতা পালন করে, মিডিয়া ম্যানুপুলেট করে তথ্য বা সংবাদ সরিয়ে দেয়, কাকের মতো চোখ বন্ধ করে রাখে। ইসলামিক সোসাইটি ফর হিউম্যান রাইটসের রিপোর্টে বলা হয়েছে, আন্দোলনের পর মব জাস্টিস, নির্যাতন এবং ভুয়া মামলা বেড়েছে, কিন্তু কোনো প্রতিবাদ নেই।
আওয়ামী লীগ নিজেই অভিযোগ করেছে, ইউএন রিপোর্টের নির্বাচিত অংশগুলো শুধু তাদের বিরুদ্ধে প্রচারিত হয়েছে, যখন প্রতিহিংসাবশত হত্যাকান্ডের একটা বিশাল সংখ্যা আর একটা নির্দিষ্ট মতবাদের, বিশ্বাস ও আদর্শের মানুষের উপর জুলুম নির্যাতন, প্রাণনাশ এর ঘটনাগুলো উপেক্ষিত থেকে গেছে।
২০২৫-এর মানবাধিকার দিবসে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা গুলোর এই দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) নতুন অধ্যাদেশ ২০২৫ প্রণয়নের মাধ্যমে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে—যা ৬০০-এর বেশি স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণে গড়ে উঠেছে।
কিন্তু ডেইলি স্টারের মতে, এটি কেবল কাগজে—বাস্তবে এক্সট্রাজুডিশিয়াল কিলিংস, কাস্টডিয়াল টর্চার এবং মব ভায়োলেন্স বেড়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, বাংলাদেশ এখন ৯টি মূল ইউএন চুক্তিতে যোগ দিয়েছে, কিন্তু অধিকার কর্মীরা বলছেন, “ফ্যাসিস্ট রেজিমের অবসান হয়েছে, কিন্তু সিস্টেম পরিবর্তন হয়নি।”
এই ১৫ মাসের রক্তপাত—প্রায় ২,৫০০-এর বেশি মৃত্যু—দেখিয়ে দিয়েছে যে মানবাধিকার রাজনৈতিক সুবিধার জন্য একটি হাতিয়ার বৈ কিছুই নয়, এবং মানবাধিকারের সংজ্ঞায় তারাই অন্তর্ভুক্ত হয় যারা উক্ত সংস্থাগুলোর উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যতা বজায় রাখে।
তাহলে কি এমনটাই দাড়াচ্ছে না যে, মানবাধিকার পশ্চিমাদের একটা অস্ত্র, যেটাকে তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমূহকে নিজেদের মতো করে, নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের লক্ষ্য পুরনে, রেজিম চেঞ্জে ব্যাবহার করা হয়, সাথে একযোগে যুক্ত হয় মানবাধিকারের রকমারি ফেরিওয়ালারা?
২০২৫-এর এই মানবাধিকার দিবস শিক্ষা দিয়েছে: ন্যায়বিচার আর সুশাসনকে উপেক্ষা করে দমন, নিপীড়ন আর গায়ের জোর খাটিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসা যায়, কিন্তু সেটা কখনো বিপ্লব হিসাবে বিবেচিত হয় না।। চে অথবা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর বিপ্লবের বয়ান দিয়ে, মার্কেটিং করে বা ফিল নিয়ে আদতে
উগান্ডার ইদি আমিন অথবা জিম্বাবুয়ের রিবার্ট মুগাবে’র আদলেই চলছে ২৪এর আগস্টের ক্ষমতা দখল উত্তর বাংলাদেশ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এখন চ্যালেঞ্জ—যা যা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যেখানে বাংলাদেশকে নিয়ে যাবেন বলে কথা দিয়েছিলেন সেই গণতান্ত্রিক ধারায়, জনমানুষের অধিকার পূরনের পথে হাঁটুন, না হলে ইতিহাস স্বাক্ষী, জরিপ যাইই বলুক না কেন, দুঃশাসক হোক আর উন্নয়নবান্ধব শাসক, শাসকশ্রেনী উপর থেকে মন উঠে যেতে এই ভূমিপুত্রদের সময় লাগে না…..
লেখক পরিচিতিঃ
মৃণ্ময় সেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মি
