কবির য়াহমদ
মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের আমল বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে অন্যতম এক (কাল) অধ্যায় হতে চলেছে। এই সময়ে সংবাদ ও সাংবাদিকতার টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ করছেন। অনেকেই বলে থাকেন আগে বাতাবিলেবুর চাষ হতো কেবল বিটিভিতে, এখন সব টেলিভিশন চ্যানেলই একেকটা বিটিভি। কথাটি টেলিভিশন চ্যানেল নিয়ে বলা হলেও মুদ্রিত সংবাদপত্র ও অনলাইন গণমাধ্যমেরও একই চিত্র।
কথাটি ভুল নয়।
এখানে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের পেশিবাদী মানসিকতা, সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুতি, মালিকপক্ষের ব্যবসায়িক স্বার্থ, সেন্সরশিপ, সেলফ সেন্সরশিপ সব রয়েছে। এগুলো স্রেফ অভিযোগের বিষয় নয়, প্রমাণিতও কিছু কিছু। বিশেষ করে ৫ই আগস্টের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর জাতীয় প্রেসক্লাব দখল, সাংবাদিকদের বহিস্কার, প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানে চাকরিচ্যুতি, হামলা-মামলা, প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধিদের চিঠি, হাসনাত আব্দুল্লাহ কর্তৃক কলম ভেঙে দেওয়ার হুমকি ও তার সরাসরি হস্তক্ষেপ একেকটা উদাহরণ হয়ে আছে। ফলে এখন অনেক জায়গায় ক্ষমতাসীনদের প্রতি স্তুতিবাক্য আর ক্ষমতাহারাদের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশই হচ্ছে শুধু, সঙ্গে আছে নিউজ-কিলিং আর ফরমায়েশি নিউজ অথবা গল্প।
আওয়ামী লীগের আমলেও কিছু মিডিয়ায় সরকারের ভয়াবহ স্তুতি-কাব্য রচিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সে যে সব সম্পাদক-সাংবাদিকেরা যেতেন, তারা অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকের চাইতে দলীয় নিবেদিত কর্মীর মত আচরণ করতেন। এনিয়ে একাধিকবার ফেসবুকে প্রতিক্রিয়ায় নিজের বিব্রত ভাবের প্রকাশ করেছি। এতে অনেকেই উপহাস করতেন ঠিক, তবে ওসব ছিল সত্যি বিব্রতকর।
জুলাইয়ের আন্দোলন চলাকালে সম্পাদক-সাংবাদিকেরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে এসেছিলেন। আগস্টেও প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একইভাবে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে এসেছেন সেই সম্পাদক-সাংবাদিকেরা। এবার এই সমর্থন বেরিয়ে এসেছে মাহফুজ আনামের মত সাংবাদিকের মুখ থেকে। মাহফুজ আনামের এই অবস্থান সমালোচনাযোগ্য বিষয় হলেও এটা সবাই এড়িয়ে গেছে। এই এড়িয়ে যাওয়া মূলত নতজানু নীতি, যা এরইমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে দৃশ্যমান।
ইউনূস সরকারের আমলে অনেক সাংবাদিক কারাগারে। অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা ঝুলছে। অধিকাংশই সেন্সরশিপের খড়গে। অনেকেই চাকরিহারা। যারা নিজেদের মুক্ত দাবি করছেন, তারা আওয়ামী লীগ আমলের মত সরকারপক্ষ সেজেছেন। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তারা বিএনপিপক্ষ সাজবেন।
সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার দুর্দিনে এখন দেখা যাচ্ছে অনেকেই ঝুঁকছেন ভিডিয়ো প্রকাশে। এখানে তাদের আশ্রয় ইউটিউব। টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যমে যখন স্বাধীন মত প্রকাশ করা যাচ্ছে না, তখন নিজেরা ইউটিউবে চ্যানেল খুলে কথা বলছেন। অনেকে লিখছেন ও কথা বলছেন ফেসবুকে।
এই সময়ে আওয়ামী লীগের নাম নিয়ে কোন টেলিভিশন চ্যানেলে কারো কথা বলার সুযোগ নাই। সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নিষেধ আছে হয়ত। নিষেধের কথা বলছি, কারণ সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দিন সাদ্দাম হোসেনকে তার ফেসবুকে অনুষ্ঠানেই নিতে পারেননি। অথচ সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহর ক্লাস ও খালেদ মুহিউদ্দিনের ক্লাসে অনেক পার্থক্য। অথচ আওয়ামী লীগ আমলে রাজপথের রাজনীতি না থাকলেও টেলিভিশন-টেলিভিশনে রাজনীতিবিদেরা কথা বলতে পারতেন। আসিফ নজরুল, নুরুল হক নুর, জোনায়েদ সাকীরা পরিচিতিও পেয়েছেন টেলিভিশন টকশোর সূত্র ধরে। এমন অনেক উপদেষ্টা আছেন যাদের নামই আগে জানা যেত না টকশোর দর্শক না হলে। এখন এই অবস্থা নেই। কথা বলা যাবে, তবে আওয়ামী লীগের পক্ষে বলা যাবে না!
এই সময়ে দেশের টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলো গণমানুষের আস্থা হারাচ্ছে। মানুষ ওসব জায়গা থেকে সঠিক সময়ে সঠিক সংবাদ পাচ্ছে না। পাচ্ছে কেবল বাতাবিলেবুর সংবাদ। সময় ও অর্থ ব্যয় করে কেইবা বলুন ফরমায়েশি সংবাদ গিলবে?
এই অবস্থা কি বদলাবে না? বদলালে কে হবে তবে পথ প্রদর্শক? আমার ধারণা এখানে পথ দেখাতে পারে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার। এই দুই পত্রিকার লোকজন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে, এবং এই দুই পত্রিকার লোকদের সরকার বিভিন্ন জায়গায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দিয়েছে। তারা বেনিফিসিয়ারি অনেকটাই। তবু তারা পথ দেখাবে।
কখন?
যখন দেখবে, অন্যায্য স্তুতিবাক্যগুলো গিলছে না আর মানুষ, আর এতে ব্যবসায় নেমে এসেছে ধস; তখন, তখনই!
সমর্থনও কি তবে লেনদেনের?
সব জায়গায় যখন দেখি পরিচিত মুখ, তখন আদর্শিক বলা কঠিন!অথচ, আজই ড. ইউনুষ বলেছেন- ‘দেশের গণমাধ্যম এখন নজিরবিহীন স্বাধীনতা ভোগ করছে’। হায়রে, কপাল বাংলাদেশের!
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সিলেট।