।। শামীম আজাদ।।

আজ লন্ডনে আন্ডারগ্রাউন্ড রেলে প্রবেশ পথে টানানো এই কবিতা দেখে ঈশিতার চোখ ভিজে গেছে। মায়ের কথা মনে হয়েছে। বিলেতে ওর মায়ের পঁয়ত্রিশটি বছর তাহলে বৃথা যায়নি। কিশোরী বয়স থেকে দেখেছে কত ভাবে কত অজুহাতে লাচারের মত যে তার মা এই অভিবাসিত বাঙালির আত্মপরিচিতিতে বাংলার বীজ বুনে দেবার জন্য প্রাণপন করেছে! এ দেখে সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মায়ের কথা ভেবে ছবিটা তুলে হোয়াটসএ্যাপে পাঠিয়েছে।

আপনারা বিলেতের এই চতুর্থ প্রজন্ম বাংলাদেশীর লেখা কবিতার বানানে কোথায় কোথায় ভুল আছে তা না খুঁজে বিদেশের বাংলাভাষি মানুষদের প্রাণটা কোথায় গৌরব খুঁজে পায় তাই উপলব্ধি করুন। আমাদের এই ছেলেমেয়েরা এভাবেই সনাক্ত ও সন্ধান করে চলেছে একুশ ও একাত্তর । এরা আমাদের উত্তরাধিকার।আমার অহংকার।
দেশে যখন ইতিহাস অনাদরে উপেক্ষায় জর্জরিত। বিদেশের এক কোটি বাঙালি তখন সদা জাগ্রত॥
বাংলাদেশে একুশ
মনেপড়ে এদিনে ভোরে আমরা রোকেয়া হল থেকে নগ্ন পায়ে, সাদা শাড়ি পরে, বুকের বাঁদিকে সেইফটি পিন দিয়ে কালো ফিতে গেঁথে আমার ভাইয়ের … গান করতে করতে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে মিনারে গেছি। আমরা দুলাইন করে যেতাম যাতে যান বাহন আমাদের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করতে পারে।
তখন ঢাকা শহরে ফুলের দোকান ছিল না। ছাত্রীহলের সামনে একটি ছেলে ঝুড়িতে চুরিকরা ফুল নিয়ে আসতো। আমাদের সামর্থ্যও ছিল না একটার বেশি ফুল কেনার। মিনার থেকে ফিরে রোকেয়া হলের শহীদ দিবসের আয়োজনে কবিতা পড়বো, কোরাসে গাইবো, মঞ্চে বসবো তাই আমাকে আর শ্রাবনীকে মালা দিয়ে যেতেন হলের নেতৃদের কেউ। সেছিলেন আভাদি বা বুয়াদি কেউ একজন। সেই বেলীফুলের মালা জড়িয়ে প্রভাত ফেরীতে যোগ দিতাম। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি ছেলেরা নানান উপায়ে রাতের বেলা ফুল সংগ্রহ করে রেখেছে। সকালে ওদের বানানো ইটের স্থাপত্যে সে ফুল দিতাম।
একটু একটু করে সূর্যের রঙ বাড়তো। আমরা এগোতাম। মোহসীন হলের ছেলেরা ব্যানার নিয়ে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি গায়ে খালি পায়ে যোগ দিতো। লাইন ক্রমশ লম্বা হতো। আগে যাবার কোন প্রতিযোগিতা ছিল না। না আগে ফুল দেবার। আসল কথাই হল ঐক্য , সমস্বরে এক গান এক কথা। গান ছাড়াও থেকে থেকে শহীদ দিবস অমর হোক শ্লোগান দিয়ে দিয়ে মিনারের দিকে এগিয়েছি। আমরা টিএস সি ফেলে শিব মন্দির ফেলে গান গেয়ে গেয়ে চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের কোয়ার্টার পেরুতে গেলে দেখেছি ওঁরা ঘুম চোখে দাঁতের মাজন হাতে আমাদের দেখতে ছোট ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
এ নিয়ে অনেক লিখেছি কিন্তু খালি পায়ের ছবি নেই।আচ্ছা আমরা ঐ অতটুকু রাস্তা কি করে খালি পায়ে যেতাম? ভাবা যায় না ! সেই সকালটা ছিল আমাদের আরাধনার সকাল।
আত্মশুদ্ধির ও আত্ম জিজ্ঞাসার। মাঝে মাঝে ভাবি ওভাবে বাংলাভাষাকে দেখেছি এবং আজও দেখি বলে এত দূর এসেছি। এ হারালে আমার আর কিছুই থাকবে না।
“মাতৃভাষা-রূপ খনি পূর্ণ মনিজালে”.. হারাইলেই কেবল তা প্রতীয়মান হয়।
শহীদ দিবস অমর হোক।
লেখক: কবি, বাচিকশিল্পী।