।। ড: মোহাম্মদ মাহমুদ হাসান ।।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ফলকার টুর্ক (Volker Turk) এর কথা শুনলাম আজকে বিবিসিতে। এটা নিয়ে একটা কুইক অভিমত লিখছি। পড়ে ফিডব্যাক দিয়েন। প্রসংগত: এই টুর্কের অফিস থেকেই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল। যদিও এটা নিতান্তই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট, বিচারিক ইনভেস্টিগেশন নয় বলে এটাকে সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স হিসেবে আদালত গ্রহণ করতেও পারে আবার নাও পারে। সেটা ভিন্ন আলোচনা।
জাতিসংঘ একটা নিরপেক্ষ সংগঠন। তার মানবাধিকার কমিশন বা OHCHR বা ফলকার টুর্ক সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবে এটাই তার দায়িত্বের প্রতি অংগীকার। এই অফিস থেকে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট হলে তাই সেটার গুরুত্ব অনেক বলেই ধরে নেই আমরা।
আজকের প্রসংগে আসি। ফলকার টার্ক আজকে বলেছেন যে তিনি বাংলাদেশের আর্মিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন যে তারা যদি আন্দোলন দমন করে তাহলে জাতিসংঘ তাদের জক্ন্য শান্তি মিশন বন্ধ করে দিতে পারে। এটা এক ধরণের হুমকি হিসেবে আর্মির উপর প্রভাব পড়েছে এবং আন্দোলন সফল হয়েছে। তারপর তিনি যোগ করেন যে অক্টোবর মাসে তিনি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন এবং ছাত্ররা তাকে তার সাহায্যের কারণে আন্দোলন সফল হয়েছে বলে অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছে।
এছাড়া অনেক কিছুই তিনি বলেছেন। আমি এই দুইটা প্রসংগে একটু আলোচনা করি।
প্রথমত: জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থাই কোন দেশের আভ্যন্তরীণ কোন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। যদি করে সেটা হবে জাতিসংঘ সনদের স্পষ্ট লংঘন। জাতিসংঘ বা এর অংগ সংগঠন কোন দেশের প্রটেস্ট হোক বা সিভিল ওয়ার হোক, কোন পরিস্থিতিতেই হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ফল্কার টুর্কের অফিসের কাজ হলো কোন দেশে এরকম পরিস্থিতি হলে অবজার্ভ করা বা মনিটর করা এবং ক্ষেত্র বিশেষে সরকারকে রিকমেন্ডেশন দেওয়া। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হলে জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলকে রেজুলেশন পাস করতে বলতে পারে। কিন্তু কোনভাবেই ফলকার টুর্ক যে কাজটি বাংলাদেশ আর্মির সাথে করেছে, সেটা সে করতে পারেনা। এটা তার দায়িত্বের প্রতি স্পষ্ট লংঘন। তার এই কাজের জন্য তার চাকরি চলে যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত: ফলকার টুর্ক আর্মিকে পিস কিপিং এ অংশ নেওয়া বা বাতিল করার কোন বিষয়েই সিদ্ধান্ত বা কথা বলার এখতিয়ার রাখেনা। পিস কিপিং মিশন একান্তই সিকিউরিটি কাউন্সিলের কাজ। ফলকার টুর্ক আর্মিকে একটা প্রচ্ছন্ন হুমকির মতো দিয়ে তার কাজের আওতার বিরুদ্ধে গেছেন। এটার জন্যও তার চাকরি যাওয়া উচিৎ।
আর আমাদের আর্মিও কেমন অশিক্ষিত! তারা কী জানেনা যে ফল্কার টুর্কের এধরণের কথা বলার এখতিয়ার নাই?
তার পরের বক্তব্য অর্থ্যাৎ, ছাত্ররা তাকে ধন্যবাদ দিয়েছে তার অফিসের সাহায্যের কারণে আন্দোলন সফল হয়েছে বলে। কী দারুণ স্বীকারোক্তিমূলক বায়াসনেসের কথা। এটা এক ধরণের কনফেশন একটা দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের ব্যাপারে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর নির্লজ্জ নাক গলানো। তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করলে তার চাকরি থাকবেনা।
কেউ কেউ আর্গু করতে পারে যে ফলকার টুর্ক যদি আর্মিকে পিস কিপিং মিশন বাতিলের ব্যাপারে হুমকি না দিতেন তাহলে আর্মি স্ট্রিকলি মাঠে থাকলে আন্দোলনকারীরা ভায়োলেন্ট নাও হতে পারতো। অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ দিশেহারা হয়ে, কেপিআই রক্ষা করতে গুলি করেছে বলেও তারা আর্গু করতে পারে। আর্মি যদি পুলিশের পাশে থাকতো, তাহলে আন্দোলনকারীরা সাহস পেতো না পুলিশকে আক্রমন করার। সেক্ষেত্রে ক্যাজুয়াল্টি অনেক কম হতে পারতো।
এখন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং এর রিপোর্টের ব্যাপারে আসি। ফল্কার টুর্কের আজকের কথায় পরিষ্কার যে তিনি একটা পক্ষ নিয়েছিলেন এবং সেটা আন্দোলনকারীদের। যিনি প্রথম থেকেই একটা পক্ষ নিয়েছেন তার অফিস থেকে নিরপেক্ষ তদন্ত বা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং আশা করবো কিভাবে? তার এই বায়াসনেস আরো দেখা যায় শেখ হাসিনার সরকারের সময় তার কর্মতৎপরতা এবং ৫ই আগস্টের পর মানবাধিকার লংঘণের ব্যাপারে চুপ থাকা দেখলে। ৫ই আগস্টের আগে তিন মাসে তিনি বেশ কয়েকবার মানবাধিকার লংঘন নিয়ে কথা বললেও পরের সাত মাসের শুরুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শুভেচ্ছা জানানোর পর (বাংলাদেশে ১৭ টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডসহ অনেক মানবাধিকার লংঘন হয়েছে) থেকে একদম চুপ।
আরেকটা বিষয় খুবই পরিষ্কার তার বায়াসনেস। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে আন্দোলনকালীন সময়ে আর্মির গুলিতে মাত্র একজন মারা গেছে, যদিও অসংখ্য ক্ষেত্রেই আর্মিকে আন্দোলনকারীদের দিকে সরাসরি গুলি করতে দেখা গেছে। যেহেতু বাংলাদেশ আর্মি ফলকার টুর্কের কথামতো সরকারের নিরাপত্তায় কাজ না করে শেখ হাসিনাকে ফেলে দিতে সাহায্য করেছে, তাই রিপোর্টে তাদের ব্যাপারে তেমন কিছু লেখা হয়নি। আর্মির পক্ষ থেকে কোন ধরণের স্টেটমেন্ট ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটিকে না দিলেও তারা এটাকে গুরুত্ব দেয়নি।
যাইহোক, জাতিসংঘ বা এর অংগসংগঠন গ্লোবাল নর্থের কথায় উঠে আর বসে। তারা যেভাবে চাইবে, জাতিসংঘও তাই করবে। ফলকার টুর্কের সাথে ক্লিন্টন বা জর্জ সরোসদের ভাল খাতির বলেই ট্রাম্প হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল থেকে আমেরিকাকে উইথড্র করে নিয়েছে। ড: ইউনুসের সরকারের প্রতি তার আজ্ঞাবহতা জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের বিকলাংগতাই প্রমাণ করে।
ফলকার টুর্কের এই নোংরা বায়াসনেস এবং বাংলাদেশে তার অন্যায় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে তার পদত্যাগ দাবী করলাম।
Step Down, Volker Turk! You are biased! You illegally interfered, you violated a state’s sovereignty! You violated the UN Charter!
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ,কার্লটন ইউনিভার্সিটি
মার্চ ৭, ২০২৫