।। শেরিফ আল সায়ার ।।
এমন একটা সময় ৭ মার্চ এলো যখন শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটা উচ্চারণ করাকেও কেউ কেউ অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি উচ্চারণে বাধ্য করা যেমন ঠিক নয়, আবার ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দ বললে তাকে আঘাত করাও ঠিক নয়। আমরা এমন একটি ক্রান্তিকালের ভেতরে আছি যখন বঙ্গবন্ধুকে বলা হচ্ছে ‘স্বৈরাচারের প্রতীক’। এমনকি এই বাহানায় বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়ি। ইতিহাস নিশ্চয়ই একদিন এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য হাজির করবে। আমরা হয়তো একদিন জানতে পারবো, যখন বুলডোজার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙ্গা হচ্ছিল তখন অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চুপ ভূমিকা কেন পালন করেছিল। যদিও ভাঙা কার্যক্রম অর্ধেক হওয়ার পর তারা একটি দায়সারা বিবৃতি দিয়েছিলেন।
যাইহোক, ৭ মার্চ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করতে চাই না। কারণ গত ১৬ বছরে এই দিনটি নিয়ে আলোচনা তো কম হয়নি। মাইক বাজিয়ে গভীর রাত থেকে বিকট শব্দে ৭ মার্চের ভাষণ শুনিয়ে মানুষকে বিরক্ত করার কাজও তো হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় ৭ মার্চ নিয়ে কম লেখালেখি তো হয়নি। টেলিভিশনে হয়েছে টকশো সহ বিশেষ বিশেষ আয়োজন। তাতে কী অর্জন করতে পেরেছে এই ঐতিহাসিক দিনটি? ৫ আগস্টের পর আমরা দেখেছি ৩২ নম্বর লুট হতে, আগুন দিতে। দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর সকল ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা হয়। এসব নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে থাকবে।
বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। হিসেব করলে প্রায় ৫০ বছর হয়ে যাচ্ছে। এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগকেও উত্থান-পতনের ভেতর দিয়েই যেতে হয়েছে। ৭৫ এর পরও তার দলের শোচনীয় পতন হয়েছিল, এখন ২০২৪ সালে আবারও তার দলের শোচনীয় পতন হলো। দলীয় আদর্শ বিবেচনায় আওয়ামী লীগ কেন বারবার এক নায়কতন্ত্রের খপ্পড়ে পড়ে যায়, কেন সে বারবার পুঁজিবাদ শ্রেণি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়- সেসব নিয়ে সমাজ বাস্তবতা ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে এখনও বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন। তাই সেসব বিষয়ে আলোচনা না করে একটু ইতিহাস চর্চার ভেতর প্রবেশ করা যাক।
বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চা বরাবরই একপাক্ষীক। ‘এ দল হটাও তো অন্য দল এসে’ তাদের নিজস্ব ইতিহাস বয়ান শুরু করে দেয়। অনেকে বলেন, আওয়ামী লীগ এককভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার একটা নিজস্ব বয়ান হাজির করেছিল। তারা সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু এক এবং এককভাবে বঙ্গবন্ধুকেই রেখে দিতে চায়। এর বাইরে কারও প্রবেশ করা নিষেধ। কথাটা অযৌক্তিক নয়। কারণ, আমরা বিগত সময়ে দেখেছি কীভাবে ইতিহাসে অতি বঙ্গবন্ধু জপ করা হয়েছে। বহুজনে বলেছেন নানান জায়গায় বঙ্গবন্ধুর নামে দোকান খুলে ব্যবসা করছে একটা শ্রেণি। যাদের কাজ হলো টাকা কামানো। যেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, সম্মান এবং ইতিহাস চর্চার বিষয়গুলো ছিল খুবই গৌন। আমরা বঙ্গবন্ধুর চার সহযাত্রী অর্থাৎ চার নেতাকে নিয়ে তেমন আলোচনা করতে দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাকেও ইতিহাসে অনেকটা হারিয়ে যেতে দেখেছি। শুধু কি তাই? ইতিহাসে যার যেটা প্রাপ্য সেটা বিগত আমলে আওয়ামী লীগ কাউকেই দেয়নি। বরং কেউ যদি সমালোচনা করেছেন তবে তাদের দলের এক শ্রেণির নেতারা তুলোধুনো করে দিতেন। সমালোচনা অপরাধ নয়, যেটা করা হতো সেটি ছিল অসম্মান।
বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের সম্মান করতেন। আমরা অনেকেই জানি যখন যুদ্ধাপরাধীদের অনেকে বন্দি ছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু তাদের পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতা করতেন। তার মূল যুক্তি ছিল- অপরাধ তো তার সন্তানরা করেনি। তারা কেন কষ্ট করবে?
এর একটি অন্যতম উদাহরণ পাওয়া যায় মহিউদ্দিন আহমদ রচিত ‘বেলা-অবেলা’ গ্রন্থে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ছিলেন এবং এ দেশে আর ফিরে আসেননি, বাংলাদেশ সরকার তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছিল। এদের অন্যতম ছিলেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি নূরুল আমীন। নূরুল আমীনকে ভুট্টো ভাইস-প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেছিলেন।… শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালের মে মাসে লন্ডনে গিয়েছিলেন। ৭ মে ফেরার সময় তিনি জানতে পারেন নূরুল আমীনের নাতনি রুমু আহমেদও একই বিমানে ঢাকা যাচ্ছে। তিনি রুমুকে ডেকে এনে তাঁর পাশে বাসিয়ে কথাবার্তা বলেন। ফ্লাইটে বসে তিনি রুমুকে একটা শুভেচ্ছাবাণীও লিখে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে রুমুর একটা ছবিও আছে, তাঁরা বিমানে পাশাপাশি বসে আছেন। রুমু কিছুদিন আগে ওই ছবি ও শুভেচ্ছাবাণীটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুকে দিয়েছেন। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘আ রেয়ার মোমেন্ট উইথ দ্য ফাদার অব দ্য নেশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হোয়াইল কামিং হোম ফ্রম ইংল্যান্ড’”।
অর্থাৎ নিজের প্রতিপক্ষ হলেও রাজনৈতিক সহকর্মী ও তার পরিবারের প্রতি সম্মানকে তিনি অক্ষুণ্ন রাখতেন। তার এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বর্তমান সময়ের রাজনীতিবিদদের মাঝে খুব একটা নেই। যদিও দেশ শাসনকালে অনেক সহকর্মীকে যারা তার বিরোধিতা করেছেন তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানকালীন সদস্য ও এক সময় বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহকর্মী অলি আহাদকে স্বাধীন বাংলাদেশে জেলেও নেওয়া হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় অভিযোগ হলো তিনি বাকশাল গঠন করে দেশে একনায়কতন্ত্র শাসন কায়েম করেন। মানুষের বাক স্বাধীনতা হরণ করেন। অন্য সকল দলের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করেন। আর তাতে তার জনপ্রিয়তা যে শূন্যের কোটায় নেমে পড়ে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। যদিও ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ একটি ভাষণে এই বাকশালে যাওয়ার নানাবিধ কারণ তিনি জনগণের সামনে হাজির করেছিলেন। তিনি বলে কয়ে এই বিতর্কিত শাসন ব্যবস্থায় ঢুকেছিলেন। এমনকি ঘনিষ্ট অনেকেই তার এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেননি। সমালোচিত তখনও হয়েছেন, এখনও সেই সমালোচনা চলছে।
এসব সমালোচনার কারণে কি বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ এর ভূমিকাকে আমরা খারিজ করে দেব? এ প্রশ্নটির মাঝেই আমাদের ঘুরপাক খেতে হয়। কেন বঙ্গবন্ধুকে অপ্রাসঙ্গিক করার এক আপ্রাণ চেষ্টা আমরা যুগের পর যুগ দেখে আসছি? সবচাইতে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যে বিএনপি হলো আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী সেই দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান কখনও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেননি কিংবা অসম্মান করে কখনও বক্তব্য দেননি।
জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কি সমালোচনা হয় না? এমনকি তার মুক্তিযোদ্ধা খেতাবটা পর্যন্ত কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল ক্ষমতাসীন থাকা দল আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ রাজনীতিতে আমরা প্রাপ্য সম্মানকে বারবার খারিজ করেছি।
এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে অধ্যাপক আসিফ নজরুলের রচিত “আওয়ামী লীগের শাসনকাল” গ্রন্থের একটি লেখার কথা মনে পড়ে যায়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ‘বঙ্গবন্ধু ‘বনাম’ শহিদ জিয়া’ অধ্যায়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘…সবচেয়ে যা ভয়ংকর, সত্যিকার বড় মানুষদের খুন করেই ক্ষান্ত হই না আমরা। তাদের নানাভাবে কাটাছেঁড়া করি, বারবার তাদের সুনাম, অবদান আর চরিত্রকে হত্যা করি। বিএনপি আমলে এর শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু, এখন হচ্ছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। বিএনপি আমলে স্বাধীনতা সংগ্রাম নির্মাণ, বিকাশ এবং পরিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করা হয়েছে। তাঁর শাসনামলের অন্য সবার সমস্ত দোষ চরম অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় তাঁর উপর। তাঁর নাম উপড়ে ফেলা হয়েছে ইতিহাস থেকে, বিভিন্ন স্থাপনা থেকে। সময় বদলেছে, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসেছে। এখন জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। অথচ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের কাছে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রেষ্ঠ সম্মান বীরোত্তম খেতাব পেয়েছেন।…’
রাজনৈতিক বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধ আমাদের জাতি হিসেবে এগুতে দিচ্ছে না। আমরা শুধু একে অপরকে খারিজ করার যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছি। বিশ্ব যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানে-ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে আমরা এখনও ইতিহাস নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বারক বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়ে নায়কোচিত বীর হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে পড়েছি।
অথচ এই পরিবর্তনে আকাঙ্ক্ষা ছিল এবার হয়তো মন খুলে ইতিহাস চর্চা আমরা দেখতে পাবো। আমরা হয়তো মন খুলে আমাদের ইতিহাসের সত্যগুলোকে প্রতিস্থাপিত করতে পারবো। বলাও হয়েছিল তেমনই। হ্যাঁ, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের বয়ানে একক বঙ্গবন্ধুকে হাজির করে বাকিদের খারিজ করে দিয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর এই পরিবর্তন কি ইতিহাসের বাকি নায়কদের পুনস্থাপিত করতে পেরেছে?
গত কয়েক মাসে মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের, শহীদদের বিরোচিত সম্মান প্রদর্শন করতে কি আমরা দেখেছি? আমরা কতবার শুনেছি তাজউদ্দীনদের কথা? কতবার আমরা বঙ্গবন্ধুর শাসনকালের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানকে খাটো করতে দেখেছি?
আমরা তো দেখিনি মুক্তিযুদ্ধের মহান শহিদদের নিয়ে সম্মানসূচক কথা বলতে। বরং ১৯৭১ সালকে খাটো করার অপপ্রয়াসও চলছে। ১৯৭১ কে ভুলিয়ে ২০২৪ কে বড় করে দেখার এক আস্পর্ধা দেখাচ্ছেন অনেকে। অথচ ১৯৭১ হলো আমাদের জন্মের ইতিহাস। সেটিকে যারা অস্বীকার করে তারা অবশ্যই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ও চেতনার বিরুদ্ধ শক্তি।
আমি ভেবে পাই না, এই দেশটি কি শুধু ক্ষমতাবানদের চাওয়ার হিসেবেই পরিচালিত হবে? এই দেশে কি সাধারণ মানুষদের মনের কথা ক্ষমতাবানরা কখনও অনুধাবন করতে শিখবে না?
আমরা দেখলাম ৭ মার্চকে জাতীয় দিবস হিসেবে বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু এই দিনটিতে বঙ্গবন্ধু যখন উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তখন কি মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্বকে অস্বীকার করা যায়? অতীতে তার লড়াই-সংগ্রামকে না হয় বাদই দিলাম।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) বিভিন্ন রাষ্ট্র ও ইস্যুভিত্তিক ব্রিফ করতো। তারই অংশ হিসেবে ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চের শুরুর দিন থেকেই নিয়মিত সেই ব্রিফে ছিল তৎকালীন পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান। ৩ মার্চ মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কেন্ট ব্লাডের একটি মন্তব্যও সেই গোপন নথিতে যুক্ত করে সিআইএ। সেখানে শেখ মুজিবের আসন্ন (৭ মার্চ) জনসভার কথা উল্লেখ করে জানানো হয়, ‘ঢাকার পরিস্থিতি একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে।’
সারা বিশ্ব জানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা। এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে গেলে যার নাম বারবার আসবে সেই ব্যক্তিটিই হলো শেখ মুজিবুর রহমান। অথচ তাকে অসম্মান করার যে রাজনৈতিক চর্চা প্রবল রূপে শুরু হয়েছে তার শেষ হয়তো আর হবে না।
তবুও নির্মোহ ইতিহাস চর্চা একটি গতি পাবে- এই স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর উপায়ও তো নেই। ক্ষমতাবানদের হাত থেকে ইতিহাসকে সবসময়ই মুক্ত রাখাই এখন প্রধান লড়াই হওয়া জরুরি।
লেখাটি শেষ করি ছেলেবেলার একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে। ছোটবেলায় আমার জীবন কেটেছে সরকারি কলোনিতে। সেখানে যে মাঠে আমরা খেলতাম, বড় ভাইদের বিশাল গ্রুপও খেলতো। ১৯৯৬ সালে আমার বোধ-বুদ্ধি হওয়ার পর প্রথম নির্বাচন দেখি। হুট করে দেখি বড় ভাইদের খেলাধুলা বন্ধ। তারা ব্যস্ত নির্বাচনি মিছিল-মিটিংয়ে। তাদের বন্ধুরা বহুভাগে ভাগে বিভক্ত। কেউ নৌকা, কেউ ধানের শীষ, কেউ লাঙ্গল, কেউ দাঁড়িপাল্লা। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তারা আলাদাভাবে মিছিল করলো। নির্বাচন শেষ হলো। দুই দিন পর দেখলাম আবার তারা এক হয়ে খেলতে মাঠে নেমে পড়লো।
এই রাজনৈতিক সহনশীলতা ও পরিমিতিবোধ তখন দেখেছি, বুঝিনি। এখন বুঝি। আদর্শ যাই হোক, সম্পর্ক কিংবা বন্ধুত্বের বন্ধনে কখনও সেটা ছাপ ফেলেনি। কিন্তু গত এক যুগে সেই সম্পর্ক নষ্ট হতে দেখেছি। সমাজে বিভাজন বাড়তে বাড়তে এখন সম্পর্কও নষ্ট হয়ে পড়েছে।
যে ইনক্লুসিভ সোসাইটি বা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা এখন খুব আলোচনায় আসছে, সেই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তো আমাদের এই দেশে ছিল। সেটি হারিয়ে গেলো। এখন সেটি পুনরুদ্ধার করার প্রক্রিয়া কি আমরা আদৌ শুরু করতে পারবো? নাকি বৈষম্যহীন মানে ‘তাকে হটাও, আমি বসবো’- এই নীতিতেই থাকবে?
লেখক: হেড অব রিসার্চ অ্যান্ড প্ল্যানিং, বাংলা ট্রিবিউন