ঢাকা, ১২ মার্চ ২০২৫ – বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার উপর নতুন করে আঘাত হেনেছে মুডিজ রেটিংসের সর্বশেষ রিপোর্ট। আন্তর্জাতিক এই রেটিং সংস্থা বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের দৃষ্টিভঙ্গি ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেতিবাচক’-এ নামিয়ে এনেছে এবং সার্বভৌম দীর্ঘমেয়াদি রেটিং B1 থেকে B2-তে নামিয়েছে। এই রেটিং হ্রাসের পেছনে রয়েছে দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনীতির দুর্বলতা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতার ঝুঁকি বৃদ্ধি। ফলে বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের আকর্ষণ কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
২০২৪ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতার জেরে তিনি পদ ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এলেও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং নির্বাচনের জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়নে তারা ব্যর্থ হয়েছে। মুডিজ এই রাজনৈতিক ঝুঁকিকে রেটিং কমানোর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, “নির্বাচনের জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনার অভাব দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের প্রতিশ্রুতির উপর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।” এছাড়া “আইন-শৃঙ্খলার অবনতি” পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও চাপ বাড়ছে। মুডিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬.৩% থেকে কমিয়ে ৪.৫%-এ এবং ২০২৬ অর্থবছরে ৬.০% থেকে ৫.৮%-এ নামানো হয়েছে। সাম্প্রতিক বিক্ষোভের কারণে দেশে সরবরাহ ব্যবস্থার বিঘ্ন এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ায় রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উচ্চ খাদ্যমূল্য এবং সরবরাহ চেইনের সমস্যার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর আর্থিক নীতি ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে তুলবে বলে মুডিজ সতর্ক করেছে।
ব্যাংকিং খাতের অবস্থাও উদ্বেগজনক। মুডিজ এই খাতের রেটিং ‘দুর্বল’ থেকে ‘খুবই দুর্বল’-এ নামিয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এবং ইস্টার্ন ব্যাংকের মতো বড় ব্যাংকগুলোর দীর্ঘমেয়াদি আমানত রেটিং-এ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া হয়েছে। সম্পদের ঝুঁকি বৃদ্ধি, গ্রাহকদের আস্থা হ্রাস এবং স্বচ্ছতার অভাব এর জন্য দায়ী। সরকারের উপর আর্থিক দায়বদ্ধতার ঝুঁকিও বেড়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং বহুমুখী বিনিময় হারের মতো অপ্রচলিত নীতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়েছে। ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়ন ডলার থাকা রিজার্ভ ২০২৩ সালে ২১.৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে এবং আগামী কয়েক বছরে ৩০ বিলিয়নের নিচে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রেটিং হ্রাস সরকার ও বেসরকারি খাতের ঋণের খরচ বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের মতো ঋণদাতারা এখন আরও সতর্ক হবে।” বাণিজ্যের উপরও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আগামী মাসগুলোতে ১০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সাহায্য আসতে পারে। কিন্তু মুডিজ সতর্ক করে দিয়েছে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে এই সংস্কার বাস্তবায়নের ঝুঁকি রয়ে গেছে।
এক সময়ের উদীয়মান অর্থনীতির গল্প এখন সংকটে। বাংলাদেশকে বিনিয়োগের আকর্ষণ ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন, নইলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।