আজ ১৭ই এপ্রিল। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথে গুরুত্বপুর্ণ এক মাইলফলক। এইদিনে আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করছি স্বশরীরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী জাতীয় চারনেতা তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও এম মনসুর আলী সহ সকল জাতীয় নেতৃবৃন্দ, মুক্তিবাহিনীসহ সকল মুক্তিযোদ্ধা, ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষাধিক বীরাঙ্গনাদের। সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নেওয়া কোটিরও বেশি শরণার্থীকে। রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে শহীদ, আহত ও যুদ্ধে অংশ নেওয়া বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের অগণিত যোদ্ধাকে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে। এটি ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার প্রতি সমগ্র জাতির অকুণ্ঠ সমর্থন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জানতো, ছয়দফা মূলতঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি কৌশলগত রূপরেখা। তাই নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে জেনারেল ইয়াহিয়ার সরকার ২৫ মার্চ কালরাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ এর নামে ঘুমন্ত-নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যা ইপিআর ওয়্যারলেস, টেলিগ্রাম এবং টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে সারা দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাঁকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে।
এমতাবস্থায়, জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ তথা গণপরিষদের সদস্যরা ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ণ করেন। ঘোষণাপত্রে বলা হয়-“সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি; এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।”
১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শতাধিক দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয় এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করে একটি মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়। পাশাপাশি এইদিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশ সরকারের শপথ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অনুমোদনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবল নৈতিক ভিত্তিই লাভ করেনি সাথে সাথে আইনি ভিত্তিও অর্জন করে। এই মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি সশস্ত্র যুদ্ধ নয়, এর ভিত্তিতে রয়েছে একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম। নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধও হয়েছে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিচালনায়। এমনকি মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এবং চিফ অফ স্টাফ দুজনেই ছিলেন ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং ১৭ এপ্রিল গঠিত গণপরিষদেরও সদস্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রই বাংলাদেশের প্রথম সরকার পরিচালনার অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে কার্যকর হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ পাকিস্তানের কারাগার থেকে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হয়ে প্রত্যাবর্তনের পর গণপরিষদ সদস্যগণ স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রচনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়।
স্বাধীনতার সনদ ও সংবিধানের মূলনীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, বাঙালী জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক শোষণমুক্ত সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল এবং জনগণের সহযোগিতায় অনেকটুকু সফলতাও অর্জন করেছিল। কিন্তু দেশি-বিদেশি অপশক্তির ষড়যন্ত্রের শিকার বাংলাদেশ এখন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবীরোধীদের দখলে। তাদের সন্ত্রাস, উগ্র-সাম্প্রদায়িকতা ও দুঃশাসনে জনজীবন যেমন বিপর্যস্ত, তেমনি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বও হুমকির সম্মুখীন। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত সংবিধানকে অস্বীকার করে তারা অসংখ্য মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে অস্বীকার করছে।
এ রকম দুঃসময়ে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার জন্য আমাদেরকে ইতিহাস ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ধারবাহিকতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আজকের বাংলাদেশ কোন বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব নয়। এই ব-দ্বীপের মানুষের অতীতের সকল লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর একুশ দফা, ঐতিহাসিক ছয়দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৭ এপ্রিল সরকারের শপথ ও স্বাধীনতা সনদ অনুমোদন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বাহাত্তরের সংবিধান সবই পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত।
গৌরবময় অতীতকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বর্তমান দুঃসময় আমরা দূর করবোই। আমাদের কাঙ্ক্ষিত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতেও সক্ষম হবো ইনশাল্লাহ! জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। আঁধার কেটে ভোর হোক।