।। পি. চট্টোপাধ্যায়।।
“শরীর আর শরীর, তোমার মন নাই কুসুম”—এই কথাগুলো যেন পুতুলনাচের ইতিকথার মর্মবাণী, যেখানে প্রেম শুধু শরীরের আকর্ষণ নয়, বরং আত্মার সন্ধান, দর্শনের গভীরতা ও জীবনের জটিলতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন। সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত এই চলচ্চিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত, গ্রামীণ বাংলার পটভূমিতে একটি গভীর, layered ও আবেগময় গল্প বুনে। এটি শুধু প্রেমের গল্প নয়, এটি জীবন, বিশ্বাস, এবং অস্তিত্বের এক দার্শনিক আলোচনা।
চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র শশী, একজন গ্রাম্য চিকিৎসক, যার জীবন যেন একটি পুতুলনাচের মতো—সুতোয় বাঁধা, তবু মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করে। তার প্রেম শরীরের তৃষ্ণা থেকে শুরু হলেও, এটি ধীরে ধীরে আত্মার গভীরে ডুবে যায়, যেখানে শশী ও কুসুমের মধ্যে এক অলৌকিক সংযোগ গড়ে ওঠে। কুসুমের চোখে যেন গ্রামের ধুলোমাখা পথের সঙ্গে মিশে থাকে তার অকথিত কথা, আর শশী তাকে খুঁজে ফেরে, যেন নিজের অস্তিত্বের উত্তর খুঁজছে। এই প্রেম আধ্যাত্মিক, কারণ এটি শুধু দুটি মানুষের মিলন নয়, বরং জীবনের অর্থ খোঁজার এক প্রয়াস।
দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে, পুতুলনাচের ইতিকথা আমাদের জিজ্ঞাসা করে—মানুষ কি সত্যিই মুক্ত, নাকি অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা এক পুতুল? শশীর জীবন এই দ্বন্দ্বের প্রতিচ্ছবি। সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, তবু তার মধ্যে এক অজানা শূন্যতা রয়েছে, যা সে প্রেম ও সম্পর্কের মাধ্যমে পূরণ করতে চায়। তার যদু পণ্ডিতের সঙ্গে প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব ও আধুনিক বিজ্ঞানের সংঘাত, জীবনের অর্থ নিয়ে এক গভীর দার্শনিক dichotomy তৈরি করে। যদু যখন নিজের মৃত্যু নাটকীয়ভাবে মঞ্চস্থ করে, তখন শশীর ভেতরের অস্থিরতা আরও গাঢ় হয়। এই দৃশ্যগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, “All the world’s a stage, And all the men and women merely players; They have their exits and their entrances; And one man in his time plays many parts, His acts being seven ages. কিন্তু আমাদের সংলাপ কে লেখে?
শারীরিক প্রেমের দিকটি চলচ্চিত্রে অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, এই প্রেম কখনোই অশ্লীলতার সীমানায় পৌঁছায় না; বরং, একটি কবিতার মতো উন্মোচিত হয়, যেখানে প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি দৃষ্টি একটি গল্প বলে। সায়ক ভট্টাচার্যের সিনেমাটোগ্রাফি এই প্রেমকে আরও জীবন্ত করে তোলে—নদীর তীরে নৌকার দৃশ্য, বৃষ্টিধোয়া গ্রামের পথ, plane crash এর পর জলের মধ্যে সারারাত আগুন জ্বলা।
অভিনয়ের দিক থেকে, আবির চট্টোপাধ্যায় শশীর চরিত্রে অসাধারণ। তার চোখে মিশে থাকে এক অদ্ভুত অস্থিরতা ও গভীরতা, যা দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। জয়া আহসান ও সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেন তারা শুধু পর্দার চরিত্র নয়, আমাদেরই পাশের মানুষ। পুতুলনাচের ইতিকথা শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি reflection of paradoxical life, যেখানে আমরা নিজেদের দেখতে পাই—আমাদের প্রেম, আমাদের দ্বন্দ্ব, আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রেম শুধু শরীরের নয়, মনের, আত্মার, আর জীবনের এক অমর কাহিনি।