বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে কলঙ্কিত করার এক ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চোখে পড়েছে ৪৭তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে। যে মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ, সেই মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নপত্রে লেখা হয়েছে ‘প্রতিরোধ যুদ্ধ’। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বলা হয়েছে নিরীহ ‘দখলদার বাহিনী’। এটা কোনো সাধারণ ভুল নয়, এটা পরিকল্পিত ইতিহাস বিকৃতি। আর এই বিকৃতির পেছনে রয়েছে জুলাইয়ের রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী মুহাম্মদ ইউনুস ও তার দোসর জামায়াতে ইসলামীর সুস্পষ্ট ছায়া।
যে দেশে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামসরা মিলে চালিয়েছিল নির্মম গণহত্যা, সেই দেশের সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় এমন শব্দচয়ন শুধু লজ্জাজনকই নয়, এটা জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। প্রশ্নপত্রে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি যেন সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কেন? কারণ যারা এখন ক্ষমতায় আসীন, তাদের আদর্শিক পিতৃভূমি তো পশ্চিম পাকিস্তান। একাত্তরে যারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে বাঙালি হত্যায় মেতে উঠেছিল, তাদের উত্তরসূরিরাই আজ বাংলাদেশের প্রশাসনিক ক্ষমতায়।
জুলাই মাসে দেশজুড়ে যে সহিংস দাঙ্গা বাঁধানো হয়েছিল, সেটা কোনো স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন ছিল না। বিদেশি অর্থায়ন, ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ আর সামরিক বাহিনীর একাংশের নীরব সমর্থনে পরিকল্পিতভাবে দেশের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। ক্ষমতায় বসানো হয়েছে মুহাম্মদ ইউনুসকে, যিনি দরিদ্রদের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে সুদের বিনিময়ে ঋণ নিয়ে নিজের সাম্রাজ্য গড়েছেন। এই অবৈধ সরকারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে জামায়াতে ইসলামী, যে দলটি একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে মিলে গণহত্যা, ধর্ষণ আর লুটপাটে অংশ নিয়েছিল।
এখন তারা যা করছে, সেটা আরও ভয়াবহ। তারা নতুন প্রজন্মের মনে বিষ ঢুকিয়ে দিতে চাইছে। বিসিএসের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় এমন প্রশ্ন রাখার অর্থ হলো পরিকল্পিতভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাথায় ঢোকানো যে মুক্তিযুদ্ধ আসলে কোনো বড় ব্যাপার ছিল না, এটা ছিল শুধুই একটা ‘প্রতিরোধ যুদ্ধ’। পাকিস্তানিরা ছিল না শত্রু, তারা ছিল নিছক ‘দখলদার’। এই ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে একাত্তরের গণহত্যাকে হালকা করে দেখানোর একটা সুচতুর চেষ্টা চলছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক সালেক খোকন যথার্থই বলেছেন যে এমন শব্দচয়ন আমাদের পাকিস্তানপ্রেমকেই স্পষ্ট করে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে। সেই দেশের সরকারি নিয়োগ কমিশনের প্রশ্নপত্রে পাকিস্তান শব্দটি এড়িয়ে যাওয়া মানে ইতিহাসকে ধোঁয়াশায় ফেলার একটা পরিকল্পিত প্রয়াস। এটা স্বাধীনতার ইতিহাসে বিভ্রান্তি ছড়ানোর নামান্তর।
জামায়াতে ইসলামী আর তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থকরা এখন প্রকাশ্যেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। কেউ বলছে শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখ নয়, কেউ বলছে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস নয় বরং কালো দিবস, কেউ আবার মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মব’ হিসেবে চিত্রিত করছে। এসব কিছুই হচ্ছে একই পরিকল্পনার অংশ। যারা একাত্তরে পরাজিত হয়েছিল, তারা এখন প্রতিশোধ নিতে চাইছে ইতিহাস পাল্টে দিয়ে।
বিহারি হত্যাকাণ্ড নিয়ে যারা কুমিরের কান্না কাঁদছে, তারা কখনো কথা বলে না পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের সহযোগী বিহারিরা মিলে কত বাঙালিকে হত্যা করেছিল। তারা কথা বলে না জয়দেবপুর, চুকনগর, হরিপাড়ার গণহত্যার কথা। তারা কথা বলে না রমনা কালীমন্দিরে হত্যাযজ্ঞের কথা। তারা কথা বলে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যার কথা। এই নির্বাচনী বৈষম্যই প্রমাণ করে তাদের আসল মতলব কী।
পাবলিক সার্ভিস কমিশন এখন জামায়াত আর তাদের মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে। এটা বলা অত্যুক্তি হবে না। কারণ এমন প্রশ্ন তৈরি হতে পারে না একক কোনো ব্যক্তির ভুলে। এটা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে অনুমোদিত হয়েছে। প্রশ্ন প্রণেতা থেকে শুরু করে যারা এই প্রশ্ন যাচাই করেছেন, সবাই এতে সায় দিয়েছেন। এর মানে হলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন এমন লোকজন বসে আছে যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করতে আগ্রহী।
কমিশনের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এখন নীরব। কেউ কোনো ব্যাখ্যা দিতে রাজি নয়। তারা জানে তাদের পেছনে রয়েছে অবৈধ সরকারের সমর্থন। তাই জবাবদিহিতার কোনো প্রয়োজন নেই তাদের। এটাই হলো বর্তমান বাস্তবতা। যে দেশে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার হয়েছিল, সেই দেশেই এখন তাদের উত্তরসূরিরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার কাজে ব্যস্ত।
মুহাম্মদ ইউনুসের সরকার শুধু একটি অবৈধ সরকার নয়, এটি একটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রতিনিধি। যারা একাত্তরে হেরে গিয়েছিল, তারা এখন ফিরে এসেছে নতুন মোড়কে। তাদের লক্ষ্য শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, তারা চায় ইতিহাসের ওপরও নিয়ন্ত্রণ। কারণ তারা জানে, ইতিহাস বদলে দিতে পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবেই না কারা ছিল মুক্তিযোদ্ধা আর কারা ছিল রাজাকার। তখন তাদের পূর্বসূরিদের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়েও প্রশ্ন তোলা সহজ হবে।
বিদেশি শক্তির সহায়তায় এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য। বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের আদলে একটা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করা তাদের উদ্দেশ্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এসব তাদের কাছে চক্ষুশূল। তাই এগুলোকে একে একে মুছে ফেলার কাজ চলছে পরিকল্পিতভাবে।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো, যে যুবসমাজ জুলাই মাসে রাস্তায় নেমেছিল, তারা অনেকেই জানে না তাদের ব্যবহার করা হয়েছে কীভাবে। তাদের সৎ আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এমন শক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল। এখন সেই তরুণদের সামনেই ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে, আর তারা নীরব দর্শক হয়ে বসে আছে।
একাত্তরের পরাজিত শক্তি কখনোই মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নিতে পারেনি। তারা বারবার চেষ্টা করেছে এই ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। আগে তারা এটা করত আড়ালে, এখন করছে প্রকাশ্যে। কারণ তাদের সময় এসেছে। ক্ষমতায় আছে তাদের লোক। প্রশাসনে বসছে তাদের সমর্থকরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ পাচ্ছে তাদের আদর্শের মানুষ। এভাবেই তারা আস্তে আস্তে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছে।
বিসিএসের প্রশ্নপত্রের এই ঘটনা একটা বড় সতর্কবার্তা। এটা শুধু একটা প্রশ্নপত্রের বিষয় নয়, এটা আসলে একটা বড় পরিকল্পনার ছোট অংশ। আজ প্রশ্নপত্রে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিরোধ যুদ্ধ লেখা হলো, কাল পাঠ্যপুস্তকে হয়তো লেখা হবে মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটা গৃহযুদ্ধ। পরশু হয়তো বলা হবে পাকিস্তান ভাঙা ছিল একটা ভুল সিদ্ধান্ত।
ইতিহাস কিন্তু এত সহজে মুছে যায় না। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে লেখা ইতিহাস কোনো প্রশ্নপত্র দিয়ে বদলানো যাবে না। দুই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগ কোনো শব্দচয়নের কারসাজিতে মুছে যাবে না। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম কোনো অবৈধ সরকারের চক্রান্তে ভুলে যাবে না বাঙালি। কিন্তু এজন্য দরকার সচেতনতা, দরকার প্রতিটি মানুষের সোচ্চার হওয়া।
যারা বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছেন, তারা নিজেরাই বলছেন এই প্রশ্ন দেখে তারা হতভম্ব হয়েছেন। কিন্তু পরীক্ষার হলে বসে তারা কিছু করতে পারেননি। এখন তাদের কথা বলা উচিত। প্রতিটি সচেতন নাগরিকের উচিত এই বিষয়ে সোচ্চার হওয়া। না হলে একদিন দেখা যাবে নতুন প্রজন্ম জানবেই না আসলে মুক্তিযুদ্ধ কী ছিল, কারা ছিল মুক্তিযোদ্ধা আর কারা ছিল রাজাকার।
মুহাম্মদ ইউনুস আর জামায়াতে ইসলামীর এই জোট বাংলাদেশের জন্য একটা বিরাট হুমকি। তারা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতায় নেই, তারা এখন ইতিহাসের ওপরও আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে। তাদের এই চক্রান্ত রুখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। না হলে একদিন হয়তো আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানবেই না তাদের স্বাধীনতা এসেছিল কত রক্তের বিনিময়ে, কত ত্যাগের বিনিময়ে।
