আজ ১৭ মার্চ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৫ তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান, মা সায়েরা খাতুন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই বাঙালিরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের পরাজিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিল। এ কারণে তাকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বলা হয়।
অন্তবর্তীকালীন ইউনুস সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অস্বীকার করে তার স্মৃতি মুছে ফেলার বহুমুখি ষড়যন্ত্রের সময়কালে ১০৫তম জন্মদিন পালিত হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর ভক্তরা নীরবে তার জন্য চোখের অশ্রু ফেলছেন। স্মরণ করছেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
বঙ্গবন্ধু কিশোর বয়স থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যোগ দেন। গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এ কারণে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো কারাবরণ করেন। ম্যাট্রিক পাসের পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের মতো রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন। এসব নেতার সাহচার্যে তিনি নিজেকে ছাত্র-যুবনেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তখন রাজনৈতিক কার্যক্রমের কারণে তিনি ইসলামিয়া কলেজেও জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নেতা হয়ে ওঠেন।
১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আযাদ কলেজ) ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এরপর একের পর এক ’৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে ’৭০ সালের নির্বাচনে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন গোটা বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়। ২৫ মার্চ কালরাতের শুরুতেই তাকে আটক করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বীর বাঙালি ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে নেয়। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি তাকে মুক্ত করা হলে লন্ডন হয়ে প্রথমে দিল্লি ও পরে ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন। দেশে ফিরেই তিনি বাংলাদেশ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন করতে গিয়ে তাকে হিমশিম খেতে হয়। তবে সেই সুযোগ বেশি দিন পাননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকের বুলেটে সপরিবারে নিহত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করায় আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময় ৪ হাজার ৬৮২ দিন জেলে কাটিয়েছেন। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের প্রায় ১৩ বছরই বঙ্গবন্ধুকে জেলে থাকতে হয়েছে। এ সময় কারাগারের ভেতরে ৮ বার জন্মদিন কেটেছে তাঁর।
বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম ১৯৫০ সালে তাঁর ৩০তম জন্মদিন কারাগারে কাটান। টানা ৭৮৭ দিন বন্দি অবস্থায় ১৯৫১ সালে ৩১তম জন্মদিনও কাটে জেলে। আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে ১৯৫৮ সালের ১১ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে টানা ১১৫৩ দিন বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে থাকতে হয়েছে। এ সময় তাঁর ৩৯তম (১৯৫৯ সাল), ৪০তম (১৯৬০) ও ৪১তম (১৯৬১) জন্মদিন কাটে জেলখানায়।
ওই দফায় ১৯৬১ সালের শেষ দিকে মুক্তি পাওয়ার কয়েক মাসের মাথায় ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি তিনি ফের গ্রেফতার হওয়ায় ৪২তম (১৯৬২) জন্মদিন তাঁকে জেলে কাটাতে হয়। এরপর ১৯৬৭ সালে ৪৭তম এবং ১৯৬৮ সালে ৪৮তম জন্মদিনও জেলখানায় কাটে বঙ্গবন্ধুর।
বঙ্গবন্ধু নিজে তাঁর জন্মদিন পালন করতেন না। জীবদ্দশায় যতবার তাঁর জন্মদিন পালনের তথ্য পাওয়া যায়, তাতে তিনি সাদামাটাভাবে দিনটি কাটিয়েছেন। জন্মদিনেও তাঁকে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় দেখা গেছে। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে ঘরোয়া পরিবেশে দিনটি পালন করা হতো। বঙ্গবন্ধুর জন্য পছন্দের খাবার রান্না করা হতো। এছাড়া তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শুভেচ্ছা জানাতেন। তারা কেক কেটে মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উদযাপন করতেন।
তবে এবার বঙ্গবন্ধুর তৈরি স্বাধীন বাংলায় এক ভিন্ন আবহে জন্মদিনটি পালিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মদদে জাতিরাষ্ট্রের ঠিকানা তার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে হানাদারের দোসররা। তারপরও বাঙালির স্মৃতি থেকে বঙ্গবন্ধুর অবদান মুছতে পারছেনা। তিনি দিনকে দিন আরো প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠছেন বলে মনে করছেন ঐতিহাসিকরা।