দেশের চার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে বিতরণকৃত বইয়ের একটি বড় অংশই এবার মুদ্রণ হয়েছে নিম্নমানের কাগজে। সরকারি তদারকির ব্যর্থতা ও দরপত্র কার্যক্রমে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী পড়ছে নিম্নমানের ছাপা বইয়ে। বই ছিঁড়ে যাচ্ছে ঘষামাজায়।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধীনে ১১৬টি মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানকে পাঠ্যবই ছাপার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতা ও যথাযথ মান যাচাই না করায় ২৯টি প্রতিষ্ঠান প্রকাশ্যেই শর্ত ভেঙে নিম্নমানের কাগজ ও ছাপার কাজে যুক্ত হয়েছে।
সরকার অনুমোদিত তদারকি সংস্থা হাই-টেক সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিস বিডির তদন্তে উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র।
তাদের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দরপত্র অনুযায়ী ৮০ জিএসএম কাগজে ছাপার কথা থাকলেও অনেক বই ছাপা হয়েছে মাত্র ৫৬-৭৫ জিএসএম কাগজে। এর ফলে বইয়ের পাতাগুলো পাতলা, সহজে ছিঁড়ে যায় এবং লেখাও অস্পষ্ট।
অভিযোগ শুধু কাগজের মান নিয়েই নয়—বাঁধাই, কাটিং, এমনকি মুদ্রণেও চরম অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে। এতে শিক্ষার্থীদের পাঠে আগ্রহ হ্রাস পাচ্ছে এবং সরকারি বিপুল ব্যয় সম্পূর্ণভাবে প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
পাঠ্যবই ছাপানো ও বিতরণে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এত বিপুল অর্থ খরচ করেও শিক্ষার্থীদের হাতে গিয়েছে খারাপ মানের বই—যা একটি উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কীভাবে দুর্নীতি ও গাফিলতির শিকার হচ্ছে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা।
অভিযুক্ত ২৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে অ্যারিস্ট্রোক্রেট সিকিউরিটি প্রিন্টিং, পাঞ্জেরি প্রিন্টার্স, লেটার অ্যান্ড কালার, মাস্টার সিমেক্স পেপার লি., নাহার প্রিন্টার্স, আমাজন প্রেস, টাঙ্গাইল অফসেট প্রেস, দিগন্ত প্রিন্টার্সসহ আরও অনেকে।
সবচেয়ে বেশি নিম্নমানের বই ছেপেছে অ্যারিস্ট্রোক্রেট প্রিন্টিং—প্রায় আড়াই লাখ কপি।
তবে হতাশাজনক বিষয় হলো, এমন ভয়াবহ অনিয়ম প্রকাশ্যে আসার পরও এনসিটিবি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। এনসিটিবির কর্মকর্তারা উল্টো মান যাচাইকারী সংস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তাদের বিষয়ে কোনো চিঠিই পাঠানো হয়নি, আর প্রতিবেদনটি পক্ষপাতদুষ্ট।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেছেন, ভুল বই সরবরাহকারীদের চিঠি দেওয়া হয়েছে নতুন করে ভালো কাগজে বই ছাপিয়ে দিতে। না হলে তাদের জামানতের ২০ শতাংশ অর্থ কেটে রাখা হবে।
কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—যেখানে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, সেখানে মাত্র জামানতের সামান্য কাটছাঁট কী যথাযথ জবাবদিহি? যারা শিক্ষার মতো একটি মৌলিক খাতে দুর্নীতির সাহস দেখায়, তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তি না দিলে এমন অনিয়মের চক্র আর থামবে না বলে সুধীজন জানান।
সরকারি এই ব্যর্থতা এবং দুর্নীতির মাশুল এখন দিচ্ছে দেশের শিশুরা—পাঠ্যবইয়ের নামে যাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ছেঁড়া, অস্পষ্ট ও নিম্নমানের কাগজে ছাপা ভবিষ্যৎ এমনটা মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।