বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও বিচারিক ইতিহাসে ২০২৫ সালের অক্টোবর মাস একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রথমবারের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সক্রিয় সেনা কর্মকর্তাদের কোনো আদালতের রায় ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে জোরপূর্বক গুম, গোপন আটক ও নির্যাতনের অভিযোগে সেনাবাহিনীর ১৫ জন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার ও পরে পদচ্যুত করা হয়। এই ঘটনাটি যেমন নজিরবিহীন, তেমনি আইনি ও নৈতিক প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে—রাষ্ট্র কি অভিযোগের ভিত্তিতেই দোষ প্রমাণের আগেই শাস্তি দিতে পারে?
অভিযোগের ভিত্তিতে বরখাস্তের নতুন আইনি কাঠামো
১০ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন জারি করেন “আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালের মূল আইনে নতুন ধারা ৯ক সংযোজন করা হয়, যা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়েরের পর সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি সেনা সদস্যদেরও তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করার ক্ষমতা দেয়। এর ফলে আদালতের রায় ছাড়াই প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে কাউকে চাকরি থেকে অপসারণ করার পথ খুলে যায়।
এই বিধান কার্যকরভাবে রাষ্ট্রকে এমন ক্ষমতা দেয়, যা বিচার ব্যবস্থার মৌলিক নীতি—“দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ”—এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অভিযোগ দায়ের মানেই অপরাধ প্রমাণ নয় কিন্তু নতুন এই আইনে অভিযোগই যেন দণ্ডের সমান।
বাংলাদেশের আইনি রীতি থেকে এক ধাপ পেছনে
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে প্রশাসনিক শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক নীতি অনুসৃত হয়েছে—কোনও সরকারি কর্মচারীকে কেবল তখনই বরখাস্ত করা যাবে, যখন তিনি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হবেন।
১৯৮৫ সালের “সরকারি কর্মচারী (দণ্ডাদেশ পেলেই বরখাস্ত) অধ্যাদেশ”–এ স্পষ্ট বলা হয়েছিল, মৃত্যুদণ্ড, পরিবহন বা ছয় মাসের বেশি কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীকেই কেবল চাকরিচ্যুত করা যাবে। অর্থাৎ বিচার ও রায় ছাড়া কোনও প্রশাসনিক শাস্তির সুযোগ রাখা হয়নি।
অতএব, ২০২৫ সালের নতুন অধ্যাদেশটি বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের আইনি ঐতিহ্য থেকে একেবারে ভিন্ন পথে হাঁটছে একটি এমন পথে, যেখানে অভিযোগই যথেষ্ট “দণ্ড” প্রয়োগের জন্য।
সংবিধানের দৃষ্টিতে বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ
বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সংসদ অধিবেশনরত না থাকলে অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন, তবে সেটি পরবর্তী সংসদ অধিবেশনের ষাট দিনের মধ্যে অনুমোদিত হতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংসদ কার্যকর নয়, ফলে এই অধ্যাদেশের সংসদীয় অনুমোদনের সম্ভাবনা অনিশ্চিত। তাই এর আইনি বৈধতা কার্যত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
অধ্যাদেশটি কার্যকর থাকলেও, সংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করলে তা স্থায়ী আইনি বৈধতা অর্জন করতে পারবে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সেনা কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিক বরখাস্ত একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হলেও তার সাংবিধানিক ভিত্তি দুর্বল।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির সঙ্গে সংঘর্ষ
বাংলাদেশ ২০০০ সালে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (ICCPR) অনুমোদন করে, যা ১৯৭৬ সাল থেকে কার্যকর। এই চুক্তির ১৪ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, প্রত্যেক ব্যক্তির ন্যায্য বিচারের অধিকার রয়েছে এবং দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে নির্দোষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
নতুন এই অধ্যাদেশ সরাসরি এই মৌলিক নীতির পরিপন্থী। অভিযোগের ভিত্তিতে বরখাস্তের এই ক্ষমতা ব্যবহার রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার অঙ্গীকারকে দুর্বল করে তোলে।
জাতিসংঘের নজরদারির প্রয়োজন
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের প্রতি নজর দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। ডোমেনিকো স্কাল্পেলির নেতৃত্বে জাতিসংঘের অফিসের উচিত এই অধ্যাদেশের বাস্তব প্রয়োগ পর্যালোচনা করা, যাতে এটি ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ থাকে। কারণ, এই ধরনের আইন প্রয়োগ যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তবে তা সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক ইতিহাসে সেনা কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিক বরখাস্ত এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ। কিন্তু এই পদক্ষেপ ন্যায়বিচার ও সংবিধানের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা—সেই প্রশ্ন এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র যদি অভিযোগের ভিত্তিতেই শাস্তি দেয়, তবে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ও নাগরিকের মৌলিক অধিকার দুটোই ঝুঁকির মুখে পড়ে।
আইন ও নৈতিকতার সীমারেখা মুছে গেলে, তা শুধু ব্যক্তির নয়—রাষ্ট্রের ন্যায্যতার ভিত্তিকেও দুর্বল করে। তাই এখন সময় এসেছে এই অধ্যাদেশের পুনর্মূল্যায়ন এবং আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার।
