কবির য়াহমদ
ডিসেম্বরে হোক আর পরের বছরের জুনে হোক, মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করুক না কেন; নির্বাচন আর পরের সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এই সময়ে তাদের বৈধতা নিয়ে কেউ উচ্চকিত না হলেও আগামীর বাংলাদেশ একদিন না একদিন তাদের বৈধতাকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেবেই।
বলে রাখি, এর জন্যে আওয়ামী লীগের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে না। আওয়ামী লীগ কোনোদিন ক্ষমতায় না আসলেও অন্য কেউ ইতিহাসের এই দায় চুকাতে উদ্যোগী হয়ে ওঠতে পারে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতা দখল ও সরকারপ্রধানের স্ট্যাটাস খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, জিয়াউর রহমান, আবদুস সাত্তার ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের চাইতে ভিন্ন নয়। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পরে দল গঠন করে নিজেদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বলে তাদের ব্যক্তি নাম ও আদর্শ টিকে গেছে। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের ক্ষমতা দখলের পক্ষে নানা কথা তাদের সমর্থকেরা বলতে পারেন, কিন্তু বাকিদের মতো ইউনূসের পক্ষে তেমন শক্তি ভিত্তি দাঁড় করানো কঠিন।
বেয়াক্কলেরা মুখে মরে। ম্যাটিউকুলাস প্ল্যানড ডিজাইনের স্বীকারোক্তি এবং ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি এই অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টদের এমন একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যে, কোনো না কোনোদিন তাদেরকে ইউএন রিপোর্টে উল্লেখ ১৪০০ জনের মধ্যে অন্তত ১০০০ মানুষের মৃত্যুর দায় নেওয়া-না নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হবেই। সরকারি-বেসরকারি বিপুল সম্পদ ধ্বংসের দায় নিতে হতেও পারে।
নানা কারণে বর্তমানে দেশে মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নাই। কিন্তু যখন সংবিধান চলমান, তখন সংবিধান অনুযায়ী তাদের বৈধতা রয়েছে প্রশ্নের মুখে। ফলে তারা সংবিধান বাতিল করতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারছে না মূলত জনগণভিত্তিক রাজনৈতিক দল বিএনপির কারণে। বিএনপি একাধিকবার দেশ শাসন করেছে বলে তারা জানে ক্ষণিকের অনাহুত অতিথির কাছে সমর্পণ করতে হয় না, তারা বিবিধ জায়গা থেকে কোণঠাসা এবং প্রবল নেতৃত্ব সঙ্কট সত্ত্বেও ইউনূস সরকারের দুরভিসন্ধিতে সায় দিচ্ছে না।
দৃশ্যত বিএনপি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে। কিন্তু প্রকৃতই তারা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও তারা ক্ষমতা থেকে দূরে। ক্ষমতাকে তাদের থেকে আরও দূরে নিয়ে যাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে। সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করে এরপর নির্বাচন দেওয়ার যে পরিকল্পনা নিয়েছে ইউনূস সরকার, এটাই তাদের মাথাব্যথার কারণ। কারণ তাদের স্মৃতিতে এখনো জাগরূক ২০১৮ সালের নির্বাচন।
প্রশাসনকে ব্যবহার করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কীভাবে বিএনপিকে নাস্তানাবুদ করা হয়েছিল সেটা বিস্মৃত হয়নি তারা। সেই প্রশাসন এখনো বহাল। সেই প্রশাসন ভাঙা কঠিন। আগে প্রশাসন আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছিল, এবার কাজ করবে ইউনূসের ছাত্রদের এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে। বিএনপির করার কিছুই থাকবে না।
মুহাম্মদ ইউনূস বারবার বলছেন, ছাত্ররা তার নিয়োগকর্তা। তিনি রাজনীতিবিদ নন, পেশাদার লোক। এখানে পেশাদারত্বের সঙ্গে তিনি তার নিয়োগকর্তা এবং নিয়োগকর্তার পছন্দের লোকদের যে নির্বাচিত করে আনবেন না সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না।
প্রশাসনের ওপর সরকারের বাইরে থাকা লোকদের ভরসা করার উপায় নাই। মাঠপ্রশাসন-পুলিশপ্রশাসন হচ্ছে হুকুমের তামিলকারী। উপরের মহলের নির্দেশ পালনে তারা বাধ্য। তা না হলে চেয়ার থাকার কথা না কারো। এটা তারা জানে। আর জানে বলেই ব্যক্তির রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই থাকুক না কেন উপরের মহলের নির্দেশ পালন করবে তারা।
পুলিশ প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমলে নিন। খেয়াল করলে দেখবেন, আগে যারা আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল, এখন তারা ইউনূসের চাইতেও বড় ইউনূস। এটাই হয়, এবং এটা হতেই থাকবে।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বাইরে রাখার পরিকল্পনা চলছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে আওয়ামী লীগের চাইতে বড় ক্ষতি হবে বিএনপির। কারণ দেশের মানুষের কাছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির এক দলের বিকল্প অন্য দল। এই দুই দল নির্বাচনে থাকলে মানুষ তাদের বিকল্প বেছে নেবে। কিন্তু এদের কোন একটা দল নির্বাচনের বাইরে থাকলে সবাই সমান হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মানুষ পার্থক্য খুঁজে পাবে না। বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে কেউ তাগাদাও অনুভব করবে না। ফলে দুই দলই সমান অবস্থানে থাকবে। আর এখানে যদি সরকারের বিএনপি-ঠেকাও কর্মসূচি অব্যাহত থাকে, তবে হতে পারে আরেক হুদা-কমিশনের জন্ম ও নির্বাচনি ফল।
নির্বাচনি ফল ও সরকারের বৈধতা নিয়ে বললাম; এখন কী করণীয় হতে পারে বিএনপির? এক্ষেত্রে কার্যকর পথ হতে পারে ইউনূস সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া। মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের কাছে নির্বাচনের দাবি না জানিয়ে বিএনপির এই মুহূর্তে নতুন কোন করণীয় নির্ধারণ করা উচিত। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি বিএনপির দীর্ঘদিনের। এই দাবিকে তারা ফের জাগরূক করতে পারে।
অনেকেই বলতে পারেন, মুহাম্মদ ইউনূস হচ্ছেন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ব্যক্তি। না। তিনি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নন। ছাত্ররা তার নিয়োগকর্তা যখন বলেছেন, এবং যখন বলছেন তিনি ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করবে, এবং তার সরকার যখন নির্বাচন আয়োজনসহ বিবিধ বিষয়ে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠন করে সংগঠিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে, তখন মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ভাবার উপায় নাই। তাদের সবকিছু ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনকেন্দ্রিক; তাই তাকে এবং তার সরকারকে নিরপেক্ষ ভাবার কোন যুক্তি থাকে না।
বিএনপি যদি তবু ভরসা করে, তবে ভুল করবে। বিএনপি যদি তবু মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের অধীনে নির্বাচনে যায়, তবে ২০১৮ সালের হুদা-কমিশনের অনুরূপ কিছু যে হবে না, এনিয়ে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না।