সংখ্যা এবং সংখ্যার প্রেক্ষাপট –
।। বি.এম.এফ. মানিক ।।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৫৫ বছর পেরিয়ে যাবার পরেও শহীদ মুক্তিযুদ্ধের সংখ্যা নিয়ে এমনকি মুক্তিযুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’ অথবা ‘ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ’ বলেও আখ্যায়িত করার চেষ্টা তারাই এখনো ফাঁকে-ফোকরে অপ্রাসঙ্গিক আর শতভাগ অগ্রহণযোগ্য-অবান্তর প্রয়াস দেখায় ,তারা মূলত ৭১ সালে বাংলাদেশের বিরোধিতাকারী গোষ্ঠী সমূহেরই তল্পিবাহক।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনা সদরে পাক বাহিনীর অফিসারদের ইন্স্ট্রাকশন দেবার সময় জেনারেল ইয়াহিয়া খান দাম্ভিকতার সাথে বলেছিলেন, “ওদের ত্রিশ লক্ষ হত্যা কর, বাকীরা আমাদের থাবার মধ্যে থেকেই নিঃশেষ হবে।”
স্বাধীনতার ৫৫ বছরে এসেও এই তল্পিবাহকেরা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত আর সন্দেহাতীত ভাবে নির্মোহ সত্য বলে বিশ্ব ইতিহাসে সংকলিত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করে…! বিষয়টিকে অবশ্য ৭১’র চেতনায় উজ্জীবিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকগনের আলাদা করে আমলে নেবার মতো বিষয় বলে মনে করি না…! কারন আমাদের ফ্যাক্ট দেখলেই পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবো সত্যি কোনটা আর মিথ্যা কোনটা।
প্রথমে যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে,সত্যকে পাশ কাটিয়ে যদি-কিন্তুর কাল্পনিক সমীকরণে কিংবা তাদের প্রকৃত লক্ষ্য অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক সত্যকে স্বীকার না করে সেটাকে ভুল-ভাল সম্ভব্যতা দিয়ে ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত সত্যকে মিথ্যা প্রমাণে বার বার অসফল প্রয়াস চালায় তারা মূলত ‘বাংলাদেশ’-রাষ্ট্রটিকেই ধারণ করে ন।
তারা শুরুতেই যেটা বলার চেষ্টা করে তা হলো মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সংখ্যা ত্রিশ লক্ষ তো বহু দূরের বিষয়….সংখ্যাটা বড় জোর কয়েক লক্ষ হতে পারে …..! তারা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে চূড়ান্তে সেই একই লেইম প্রশ্ন আনে…!! তারা বলে- ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের পক্ষে নাকি যুদ্ধের এই সময় কালে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা কোনো ভাবেই সম্ভব না….!! গণহত্যা নিয়ে যাদের অল্প বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি আছে, সে যদি ক্যালকুলেশন আর ফ্যাক্ট এনালাইসিসে একেবারে ‘ক-অক্ষর গোমাংস’ও হয় তবুও তার পক্ষে এমন অবান্তর কথা সম্ভব হবে না।
হিস্ট্রিক্যাল ডিকলারেশন এন্ড ক্যালকুলেশন এনালাইসিসঃ
১৯৮১ সালে ইউ এন ইউনির্ভাসাল হিউম্যান রাইটসের ডিকলারেশন – – –
“মানব ইতিহাসে যত গণহত্যা হয়েছে এর মধ্যে বাংলাদেশের ১৯৭১’ এর গণহত্যায় স্বল্পতম সময়ে এই সংখ্যা সর্ববৃহৎ। গড়ে প্রতিদিন ৬,০০০ – ১২,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।” .. .. .. এটি হচ্ছে গণহত্যার ইতিহাসে প্রতিদিনে সর্ব্বোচ্চ নিধনের হার।
তার মানে ‘৭১ এর ‘২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর’ -এই ২৬০ দিনে পাক বাহিনী প্রতিদিন লোয়ার স্কেলে (৬০০০×২৬০) বা ১৫ লক্ষ ৬০ হাজার আর আপার স্কেলে হিসেবে করলে (১২০০০×২৬০) বা ৩১ লক্ষ ২০ হাজার বাঙ্গালীকে হত্যা করেছে । আমরা যদি ইউএন-এর প্রদেয় স্কেলের মাঝামাঝি একটা পয়েন্টে স্কেল করি তাও (৯০০০×২৬০) বা ২৩ লক্ষ ৪০ হাজার হবে সংখ্যাটা ।
৭১-এ আমাদের জনসংখ্য ছিল সাত কোটি পঞ্চাশ লক্ষ । পরিবারে ন্যুনতম ৫ জন করে হলে মোট পরিবার সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৫০ লক্ষ । অর্থাৎ প্রতি পরিবারে গড়ে ০.১৬ জন করে মারা গেছেন । তার মানে প্রতি ১০০ পরিবারে পাক বাহিনী দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল ১৬ টি পরিবার ।
সৈন্য সংখ্যায় হিসেব করলে পুরো ৯ মাসে পাক বাহিনীর প্রত্যেক সৈন্য অন্তত ২৬ জন বাঙ্গালীকে হত্যা করেছে ।
বিঃ দ্রঃ – –
পুরো ক্যালকুলেশন এনালাইসিসে শুধুমাত্র পাক বাহিনীর ডিক্লায়েরড সৈন্য সংখ্যা কাউন্ট করেই এখানকার এনালাইসিস । এখন যদি এই সৈন্য বাহিনীর সাথে তখনকার এদেশীয় দোসর রাজাকার – আল বদর – আল শামস সহ প্রায় লাখের উপর সংখ্যাটা কিন্তু ক্যালকুলেশন এনালাইসিসের বাইরে। পাক বাহিনী এদের সাথে সমন্বয় করে তাদের সহযোগিতায় শহর থেকে শুরু করে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামেও গণহত্যা চালিয়েছিল। এমনকি কখনো কখনো পাক বাহনির বাহিরেও এই রাজাকার-রা বহু হত্যাকান্ড-ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে ।
★★★ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত যুদ্ধকালীন বিশ্লেষণঃ
● টাইমস একাত্তরের এপ্রিলের শুরুতেই লিখেছে ৩ লাখ ছাড়িয়েছে এবং বাড়ছে।
● নিউজউইক এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ১৯৭১ লিখেছে সাত লাখ।
● দ্য বাল্টিমোর সান ১৪ মে ১৯৭১ লিখেছে ৫ লাখ।
● দ্য মোমেন্টো, কারাকাস জুনের ১৩ তারিখে লিখেছে ৫ থেকে ১০ লাখ।
● কাইরান ইন্টারন্যাশনাল ২৮ জুলাই লিখেছে ৫ লাখ।
● ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ২৩ জুলাইয়ে রিপোর্ট করেছে, সংখ্যাটা ২ থেকে ১০ লাখ।
● টাইমস সেপ্টেম্বরে বলছে ১০ লক্ষাধিক।
● দ্য হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট এক্সপ্রেস, লন্ডন ১ অক্টোবর ১৯৭১ বলেছে শহীদের সংখ্যা ২০ লাখ।
● ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে লিখেছে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ।
অতএব দেখা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ শহীদের ব্যাপারটা হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠেনি। আন্তর্জাতিক দৈনিকগুলোই বলছে এপ্রিলে সাত লাখ, জুলাইতে দশ লাখ, সেপ্টেম্বরে বিশ লাখ তাহলে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কাল নির্ভর গণনায় তিরিশ লাখ সংখ্যাটিকেই প্রমাণ করে ।
একজন সাধারণ মানুষের হিসাব:
সবশেষে যদি একেবার অক্ষর জ্ঞানহীন একেবার প্রত্যন্ত গ্রামের একজন ধর্মভীরু-দেশপ্রেমিক-কর্মঠ-ন্যায় পরায়ণ-সরল মনের একজন বাংলাদেশির চোখে এই সংখ্যা আর সংখ্যার যৌক্তিকতা দেখাই, সেটাও পূর্বপর কোনো ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত,তথ্য-উপাত্ত নির্ভরশীল, টাইমফ্রেম বেইজ্ড ক্যালকুলেশন,নিয়ামেরিক এনালাইসিস প্রভৃতি পদ্ধতির চেয়ে কোন অংশেও কম অগ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে না…!!
একাত্তরে আমাদের গ্রাম ছিল প্রায় ৬৮ হাজার। আর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা প্রসঙ্গে বিভিন্ন হিস্ট্রিক্যাল রিসোর্স ইনফো , টাইমফ্রেম বেইসড ক্যালকুলেশন বা নিয়ামেরিক ডাটা এনালাইসিস প্রভৃতি ক্যাটাগরি থেকে প্রাপ্ত সামারি ত্রিশ লক্ষ হিসেবেই নির্ধারিত হয় । এখন যদি আমরা এই ত্রিশ লক্ষকে ৬৮ হাজার দিয়ে ভাগ করি তাহলে পুরো দেশে গড়ে প্রতি গ্রামে ৪৪.১২ বা ৪৫ জন বাঙালি পাকিস্তানি সেনা দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছে। আবহমান গ্রাম বাংলার পূর্বাপর বিবেচনায় নিলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকালীন সময়ে একটি গ্রামে আনুমানিক ৪৫ জন হত্যার শিকার হয়েছে পাক বাহিনীর হাতে কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণেই অবাস্তব বা অগ্রহনযোগ্য বলে মনে হবে না । অতএব, যে বা যার মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কিংবা মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করে, তারা বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধ কোনটাই ধারণ করতে পারে নি…! যেমনটা অতীতে তাদের পূর্ব পুরুষরাও পারে নি ।।
(তারিখ: ঢাকা, ২৮ ফেব্রুয়ারি,২০২৫ ইং)