।। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ ।।
“নির্বাচন চাইলেই বলা হচ্ছে, বিএনপি নাকি বালুর ট্রাক সরাতে পারে নি। মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান যে-ছেলেটিকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলেছেন, বালুর ট্রাকের প্রতিক্রিয়ায়, সে-ছেলেটি রাজাকারতন্ত্রের সুরেই কথা বলেছে। যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সেন্টিমেন্টটা অমুক্তিযোদ্ধারা সহজে ধরতে পারবেন না। কেউ রাজাকারের বাচ্চা, এর মানে এই নয় যে তার বায়োলোজিক্যাল ফাদার রাজাকার ছিলো। ‘রাজাকারের বাচ্চা’ একটি আমব্রেলা টার্ম। এর অর্থ বিশদ ও বিস্তীর্ণ। রাজাকাররা যা করেছিলো, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, বাঙালির বিরুদ্ধে, বাঙালির জাতিমূল ও সংস্কৃতির বিপক্ষে, তা ধারণ করাই রাজাকারগিরি। রাজাকারের বাচ্চাগিরি। ক্ষমতাবান নষ্টরা ‘রাজাকার’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ’— দুটি শব্দকেই খেলো করে তুলেছিলো, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা জন্ম দিয়েছিলো, এ জন্য এগুলো নিয়ে আমরা কখনো লিখি নি, মুক্তিযোদ্ধারাও কথা বলেন নি।
কিন্তু এখন মুক্তিযোদ্ধারা মুখ খুলছেন, কারণ বিপদ কাটিয়ে রাজাকাররা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। তারা হা করে পাকিস্তানী দাঁত দেখাচ্ছে। মুখ খুললেই বোঝা যাচ্ছে কে রাজাকারের বাচ্চা, কে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। মুক্তিযোদ্ধারা মাঝেমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা চিনতে ভুল করেন, কিন্তু কখনো রাজাকার চিনতে ভুল করেন না। বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্রমা ও ট্রাজেডির নাম রাজাকার। বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সাথে রাজাকাররা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো। পাকিস্তানীরা শত্রু ছিলো, কিন্তু রাজাকাররা এ মাটির সন্তান হয়েও আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলো।
রাজাকারের বাচ্চা কী জিনিস, তা বুঝতে চোখ বন্ধ করুন। ফিলিস্তিনের জন্য যাদের মন কাঁদে, তারা ফিলিস্তিনের কথা ভাবুন। কল্পনা করুন, ফিলিস্তিনে জন্ম নেওয়া রাজাকাররা ফিলিস্তিনীদের হ/ *ত্যায় সহযোগিতা করছে, যুবতী নারীদের ধরে ইসরায়েলী সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে, ফিলিস্তিনী বুদ্ধিজীবীদের ঘর-বাড়ি দেখিয়ে দিচ্ছে, তুলে নিচ্ছে চোখ বেঁধে, মুক্তিসংগ্রামীরা কোথায় গোপন ঘাঁটি গেড়েছে তা জানিয়ে দিচ্ছে, এবং রাজাকারদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ইসরায়েলীরা অভিযান চালাচ্ছে, বোমা ফেলছে। ঠিক এ জিনিসটাই ৫৫ বছর আগে বাংলাদেশে ঘটেছিলো।
আজ আপনার মনে হচ্ছে, না, কিছুই ঘটে নি। পাকিস্তানী মুসলমান ভাইয়েরা এমন কাজ করতেই পারে না! কিন্তু এটাই হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের শহীদরা অমুসলমান ছিলো না। ধর্ষিতারা অমুহাম্মদী ছিলো না। ফিলিস্তিনে একজন মারা গেলে আপনি উঁ করে উঠেন, কিন্তু বাংলাদেশকে জন্ম দিতে যে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিলো, তাদের আত্মত্যাগকে কিছুই মনে করেন না। এই যে ‘কিছুই মনে না করা’, এটাই রাজাকারের বাচ্চাগিরি। আমার তো সাহসই হবে না ফজলুর রহমানের মুখের উপর কথা বলতে। আমার পাশের ঘরে ‘জহুর আলী’ নামে এক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। হতদরিদ্র। নিরক্ষর। ঘরটাও অন্যের উঠানে বানানো। বিপুল শিক্ষিত, বিপুল জ্ঞানী মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমি তার সামনে ক্ষুদ্র প্রজাপতির মতো দাঁড়াতাম। বিস্ময় নিয়ে তাকাতাম।
রাজাকারের বাচ্চার মুখে যে-শ্লোগানই উচ্চারিত হোক না কেন, তার গোপন অর্থ— পাকিস্তান জিন্দাবাদ। রাজাকারের বাচ্চা যদি জয় বাংলা বা বাংলাদেশ জিন্দাবাদও বলে, তাহলেও তার গোপন অর্থ পাকিস্তান জিন্দাবাদ। শ্লোগানে ‘কী’ বলা হচ্ছে, তার চেয়ে শ্লোগানটি কারা দিচ্ছে, কী উদ্দেশ্যে দিচ্ছে, তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিযোদ্ধারা ‘নাই’ হতে চলেছেন। হাতেগোনা কিছু মানুষ বেঁচে আছেন। একদিন কেউই থাকবেন না। ফজলুর রহমান যদি টকশোতে গিয়ে পাগলামীও করেন, তবুও আমি এটা উপভোগ করবো। বকা দিলে আশীর্বাদ ভাববো। হাত তালি দেবো। হাসবো। তর্ক করার দৃষ্টতা দেখাবো না। আমি বিনয়ী মানুষ নই, কিন্তু ফজলুর রহমানদের সামনে নতজানু বিনয়ী।
শিক্ষার বড় উদ্দেশ্য হলো, যাদের কাছে ঋণ আছে, তাদের ঋণটা স্বীকার করা। আমি যেসব লেখকের বইপত্র পড়েছি, যাদের লেখা আমাকে প্রভাবিত করেছে, তাদের প্রত্যেককে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। মনে মনে কতোবার তাদের ধন্যবাদ জানাই। ভালোবাসা জানাই। তবে রাজাকারদের এ বালাই নেই। রাজাকারের বাচ্চারা ঐতিহাসিকভাবেই কৃতঘ্ন। রাজাকার ঘৃণাবাচক শব্দ, এটা জেনেই এর বিপরীতে বাজারে ছাড়া হয়েছে ‘শাহবাগী’ শব্দটি। যেকোনো স্বাধীন প্রতিবাদী মানুষকে শাহবাগী ডাকা হচ্ছে। নারীদের বেশি ডাকা হচ্ছে। উদ্দেশ্য— ভেতরে লুকিয়ে রাখা রাজাকারের বাচ্চাটির আত্মগ্লানি মোচন করা।” ৫ মার্চ ২০২৫
লেখক: কবি ও কথা সাহিত্যিক।