
মিহিরকান্তি চৌধুরী
নিউইয়র্কের জন্মকাহিনির অংশ হয়ে উঠেছে এই ঐতিহাসিক লেনদেন। কিন্তু এই গল্পের পৌরাণিক অংশগুলো কি প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করে দিয়েছে?
১৬০৯ সালে হেনরি হাডসন বর্তমান নিউইয়র্কের নদী বেয়ে নেমে আসেন — যে নদী পরে তারই নামে পরিচিত হবে। ইংরেজ এই অভিযাত্রী ছিলেন ডাচদের দূত এবং তাঁকে পাঠানো হয়েছিল এশিয়ার দিকে নতুন নৌপথ খুঁজে বের করার জন্য, যেখানে ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে চেয়েছিল। যদিও হাডসন সেই লক্ষ্যে ব্যর্থ হন, তাঁর যাত্রাই নিউইয়র্কে ডাচ উপনিবেশ স্থাপনের ভিত্তি তৈরি করে।
“দৃশ্যটা নিশ্চয়ই অপূর্ব ছিল,” বলেন এরিক স্যান্ডারসন, নিউইয়র্কের ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির একজন ল্যান্ডস্কেপ ইকোলজিস্ট। “জলের দিক থেকে দেখলে ম্যানহাটন ছিল লম্বা, সরু, বনভূমিতে আচ্ছাদিত এক দ্বীপ, তীরে বালুকাময় সৈকত, আর পশ্চিম দিকে উঁচু পাহাড় ও খাড়া ক্লিফ। নিচু ম্যানহাটনে লেনাপে জনগোষ্ঠীর ধোঁয়া উঠতে দেখা যেত।” শরতে হয়তো দেখা যেত হাডসন নদীর ধারে অভিবাসী বাজপাখি, আর নদীর জলে ভরপুর থাকত ডলফিন ও তিমিতে, স্যান্ডারসন লাইভ সায়েন্স-কে জানান। ইতিহাসভিত্তিক বিবরণ ও নিউইয়র্ক সিটির মানচিত্র মিলিয়ে উপনিবেশ-পূর্ব শহরের সজীব প্রাকৃতিক চিত্র পুনর্গঠনে তিনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত।
১৭শ শতকের নিউইয়র্কে প্রচুর ছিল ভোঁদড়ও — হাডসন সম্ভবত এই তথ্যই ডাচ সহকর্মীদের জানিয়েছিলেন। ফলে হল্যান্ড থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে বসতি গড়ে তুলল “নিউ আমস্টারডাম”-এ এবং শুরু হলো বিশালাকার পশম বাণিজ্য। তখন ভোঁদড়ের নরম লোম হল্যান্ডে টুপি তৈরির জন্য অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। এই বাণিজ্যই ডাচ ও অঞ্চলের আদিবাসীদের — বিশেষত লেনাপে ও মাহিকান জনগোষ্ঠীর — মধ্যে এক স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি করল। তারা শিকার করে শত-সহস্র পশম সরবরাহ করত ধাতব দ্রব্য, কাপড় ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসের বিনিময়ে।
কিন্তু পরবর্তী কয়েক দশকে এক ভিন্ন বাণিজ্যের কাহিনি ছড়িয়ে পড়ল, যা ভোঁদড়ের চামড়ার বাণিজ্যের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত নিউইয়র্কের ইতিহাস গঠন করে। গল্প অনুযায়ী, ১৬২৬ সালে আদিবাসীরা পুরো ম্যানহাটন দ্বীপ ডাচদের কাছে বিক্রি করে দেয় মাত্র ২৪ ডলারের পুঁতি ও “খেলনা সামগ্রী”-এর বিনিময়ে। এই ক্ষুদ্র লেনদেনের গল্প পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে এত গুরুত্ব পায় যে ইতিহাসবিদ পল অটো ২০১৫ সালের এক প্রবন্ধে একে “নিউইয়র্ক সিটির জন্ম সনদ” হিসেবে অভিহিত করেন।
তবুও এই গুরুত্বপূর্ণ বিনিময়টি কীভাবে ঘটেছিল, আর কেন বহু শতাব্দী ধরে ভূমিতে বসবাসকারী মানুষ এটি এত সহজে ছেড়ে দিল — তার বিস্তারিত তথ্য আজও অজানা। আজও প্রশ্ন রয়ে গেছে: এই ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশটি কি সত্যিই সত্য?
বর্তমান নিউ ইয়র্ক ডাচ উপনিবেশের স্বাভাবিকায় নিউ আমস্টারডাম নামে পরিচিত ছিল। ১৬৬৪ সালে “নিউ ইয়র্ক” নামে পরিচিত হয়।
ঘটনাটি এমন ছিল —
ডাচরা ১৬২৪ সালে ম্যানহাটনে “নিউ আমস্টারডাম” নামে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে। কিন্তু ইংরেজরা তখন উত্তর আমেরিকায় তাদের প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছিল। ১৬৬৪ সালে ইংরেজ নৌবহর হঠাৎ করে নিউ আমস্টারডাম দখল করে নেয়, এবং প্রায় কোনো রক্তপাত ছাড়াই ডাচ গভর্নর পিটার স্টুইভেসান্ট আত্মসমর্পণ করেন।
ইংরেজ রাজা চার্লস দ্বিতীয় (Charles II) তাঁর ভাই ইয়র্কের ডিউক (Duke of York) — পরে যিনি রাজা জেমস দ্বিতীয় হন — তাঁর নামে শহরটির নাম রাখেন “New York” (নিউ ইয়র্ক)।
তবে ডাচরা কয়েক বছর পর (১৬৭৩ সালে) অল্প সময়ের জন্য শহরটি পুনরায় দখল করে এবং তখন নাম দিয়েছিল “New Orange” (নিউ অরেঞ্জ), কিন্তু ১৬৭৪ সালে আবার ইংরেজরা তা পুনরুদ্ধার করে স্থায়ীভাবে “নিউ ইয়র্ক” নামেই রাখে।
লেখক: অনুবাদক ও লেখক, নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার সিলেট।
