বাংলাদেশও হতে পারে ভবিষ্যতের সুদান।নুবিয়ার রাজ্য, সেনার রাজবংশ হয়ে ১৮২১ সালে মিশরের সাথে একত্রিত হওয়ার পর ১৯৫৬ সালের ১ লা জানুয়ারি যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীন হয়।২০০৫ সালের ৯ ই জানুয়ারি সুদান তাদের বর্তমান সংবিধান রচনা করে।
৬০ হাজার বছর আগেও আফ্রিকার এই দেশটিতে মানব বসতি ছিলো। প্রাচীনকাল থেকেই মিশরের সাথে সুদানের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধন ছিলো যেমন করে বাংলাদেশের সাথে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার মানুষের একটা ভাষা ও সংস্কৃতির আত্মিক বন্ধন ছিলো। সুদানের সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল কুশ, যার রাজধানী ছিল ‘নাপাটা’।যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৭৫০ বছর আগে মিশরীয়রা নাপাটা রাজ্য দখল করে মেরোটিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। মিশরের মত পিরামিড মেরোটিকরা সুদানেও নির্মাণ করেছিল। বাংলাদেশের মানুষের সাথে ভারতের মানুষের যেমন হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতির মিল এবং সেখানে থেকে আর্য , পাল ও সেনরা বিভিন্ন ধর্মীয় মন্দির তৈরি করেছে, ঠেক তেমনি মিশরীয়রা সুদানে গড়ে তুলেছিলো পিরামিড।
মধ্যযুগে সুদানের মানুষ খ্রিষ্টান নুবিয়ান রাজ্যর দখলে ছিলো। খ্রিষ্টানদের সেই নোবাটিয়া রাজ্য সুদানের মানুষ আইসিস দেবীর উপাসনা করতো।বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবেন প্রায় ৬৬৫ বছর বাংলাদেশের মানুষ আরব থেকে আসা মোঘল ও আফগান রাজাদের শাসনে ছিলো।পঞ্চদশ শতকে সুদানে ইসলামী সাম্রাজ্য ফাঞ্জ সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়।১৮২০ সালে ওসমানীয় শাসক মুহাম্মদ আলী পাশা সুদান দখল করেন।১২ শতকে যেমন করে ইখতিয়ার খলজিরা বাংলাদেশ দখল করেছিলেন।পাশার ছেলে ইসমাইল পর্যন্ত সেই সাম্রাজ্য টিকে থাকলেও ১৮৮২ সালে ইসমাইলের ছেলে তৌফিক তার দূর্নীতিগ্রস্থ শাসন টিকিয়ে রাখতে ব্রিটিশদের সহযোগিতা কামনা করলে ব্রিটিশরা এই সুযোগে সুদান দখল করে নেয়।১৭৫৭ সালেও বাংলার জগৎশেঠ , মীরজাফর ও ঘসেটি বেগমরা একই কায়দায় ব্রিটিশের সাহায্য কামনা করলে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন হয়।
১৯৮৯ সালে ৩০ শে জুন কর্ণেল ওমর আল বশির সুদানে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশটিতে ইসলামি আইন চালু করেন। সুদানে যেটা ১৯৮৯ সালে হয়েছে বাংলাদেশে তা হয়েছে ৩৬ বছর পর ইউনূসের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৫ ই আগষ্ট। এর সাত বছর পর ১৯৯৬ সালে ওমর আল বশির সুদানে গেরিলা হত্যার নামে হাজার হাজার মুসলমান হত্যা করে নিজেকে সুদানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, এবং একমাত্র প্রেসিডেন্ট প্রার্থী তিনিই ছিলেন।আর কয়েক বছর পর ডক্টর ইউনূস নিজেকে ওমর আল বশিরের অনুসারী হয়ে অঘোষিত প্রেসিডেন্ট দাবি করলে আমি অন্তত অবাক হবো না।২০০৫ সালের ৯ ই জানুয়ারি নিজের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে ওমর আল বশির জাতিসংঘের সাথে একটি চুক্তি করছ ২৪ শে মার্চ সুদানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করেন। বাংলাদেশের ইউনূসের সাথে জাতিসংঘের গুতেরেসের যে দহরম-মহরম সম্পর্ক তাতে ভবিষ্যৎতে আওয়ামীলীগ দেশ বাঁচাতে গৃহযুদ্ধের পরিকল্পনা নিলে ধূর্ত ইউনূস যে সুদানের পথে হাঁটবেন না , সেই গ্যারান্টি কে দিবে ?
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের ত্রিশ লক্ষ শহীদের গণহত্যা ও ৪ লক্ষাধিক মা ও বোনের ধর্ষণের এক বছর আগেই ১৯৭০ সালে সুদানের দারফুর গণহত্যা চালানো হয়।এতে বাংলাদেশের যেমন এক কোটির অধিক শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল ঠিক একইভাবে সুদানের কয়েক লক্ষ মুসলমান তাদের পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র চাদে আশ্রয় গ্রহণ করে।
গত কয়েকদিনে সুদানের আধাসামরিক বাহিনী আরএসএফ এল- ফাশের শহর দখল করে নিলে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ( ইউএনএইচসিআর) এর তথ্যমতে, ” সুদানের প্রায় ৬০ হাজারের বেশি মানুষ আল- ফাশের শহর থেকে পালিয়ে গেছে। বেসরকারি ভাবে বলা হচ্ছে, এই গৃহযদ্ধে প্রায় দেড় লাখ মানুষ ইতিমধ্যে মারা গেছেন।গত কিছুদিন আগে বাংলাদেশের জুলাই – আগষ্টের মেটিকুলাস ডিজাইনের পর এই ইউএনএইচসিআর এর তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে গত দেড় বছরে প্রায় ১ লাখ ৫৯ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।গত আগস্টের বাংলাদেশের অবস্থা ও তার ঠিক এক বছর পর সুদানের এই গৃহযুদ্ধ যেন একই সুতোয় গাঁথা। বাংলাদেশে যেভাবে গত দেড় বছরে রাজনৈতিক সহিংসতার নামে হাজার হাজার মানুষ হত্যা ও ধর্ষণ করা হয়েছে, নদীতে লাশের পর লাশ ভেসেছে , আজকের সুদানের অবস্থাও তাই।এই পর্যন্ত সুদানের জাতিগত সংঘাতে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ সুদান ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
২০১১ সালে একটি গণভোটের পর দক্ষিণ সুদান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।১৯২৪ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যর পতন ও ব্রিটিশের দখলে সুদান এবং সেই ধর্মীয় বিভক্তি আজও সুদানের একটি প্রধান সমস্যা। সুদানের উত্তরাঞ্চল হচ্ছে মুসলিম অধ্যুষিত এবং দক্ষিণাঞ্চলে অমুসলিম ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বসবাস। সুদানের উত্তরাঞ্চল এখনও আরব প্রভাবিত এবং দক্ষিণাঞ্চলের অমুসলিমরা উন্নয়ন বঞ্চিত হয়ে দক্ষিণ সুদান গঠন করে। উত্তর সুদানে ২৫ টি রাজ্য এবং দক্ষিণ সুদানে ১০ টি রাজ্য অবস্থিত। উত্তর সুদানের মুসলমানরা এখনও দুইভাগে বিভক্ত।একভাগে স্থানীয় ( নুবিয়ান ) মুসলমান আর অন্যভাগে আরব থেকে আসা বহিরাগত মুসলমান। অপরদিকে দক্ষিণ সুদানের মানুষ খ্রিষ্টান ও প্রকৃতি পূজারি।১৯৮৩ সালে সুদানের দুর্ভিক্ষ ও গৃহযুদ্ধে প্রায় ২০ লাখ মানুষ নিহত হয়।
তথাকথিত ইরানের আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির ছদ্মবেশে সুদান শাসন করা বশিরের তিন দশকের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে সুদানে জেনারেল আব্দুল ফাত্তাহ আল – বুরহান ও জেনারেল হামদান দাগালো এর নেতৃত্বে একটি একটি সামরিক অভ্যুত্থানে বশিরের সরকারকে উৎখাত করা হয়।২০১৩ সালে আরেক আরব রাষ্ট্র আরব আমিরাতের ছত্রছায়ায় ও অর্থায়নে সুদানে আরএসএফ গঠন করা হয়।ব্রিটিশরা ১৯৪১ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে যেমন করে জামায়াতে ইসলাম নামক বিষফোঁড়ার জন্ম দিয়েছিলো ভারতীয় উপমহাদেশকে হিন্দু ও মুসলিম দুইভাগে বিভক্ত করে মুসলমান ও মুসলমানদের যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়ার জন্য ঠিক একই কায়দায় ব্রিটিশের” টু নেশন থিওরি” অনুসরণ করে উত্তর সুদানকে আরো দুইভাগে বিভক্ত করার জন্য নূবিয়ান মুসলমান ও আরবের মুসলমানদের মধ্যে একটি গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তথাকথিত আরবের মুসলমানরা নুবিয়ান জাতিকে নৃশংসভাবে হত্যা ও ধর্ষণ করছে। ঠিক যেমন করে পাকিস্তানীরা ১৯৭১ সালে বাঙালি মুসলমানদের ভারতের দালাল ও হিন্দু বানিয়ে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণহত্যা চালিয়েছিল। বাঙালি জাতিকে নির্মূল করতে পাকিস্তানীরা যেভাবে গণহত্যা চালিয়েছে ঠিক একই কায়দায় ‘ জাতিগত নির্মূল অভিযান’ এর নামে সুদানে মুসলমানরা গণহত্যা চালাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র যেমন দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জামায়াতে ইসলামী নামক ৪০ টি জ-ঙ্গী সংগঠনের জন্ম দিয়েছে , ঠিক একই কায়দায় মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পালিত দাস আরব আমিরাতকে ব্যবহার করে উত্তর সুদানকে আরো দুটি ভাগে ভাগ করতে চাইছে।একই কায়দায় ২০২৪ সালের ৫ ই আগষ্ট মেটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে ইউনূসের সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে বাংলাদেশের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান সাম্প্রদায়িক সংঘাত উস্কে দিয়েছে।২০২৪ সালে ইউনূস সরকারের অত্যাচরে লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। আজকের সুদান যেন ২০২৪ ও ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের সেই রক্তমাখা ইতিহাসের কথা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।
সত্য সবসময় সুন্দর। লুসিড ড্রিম ০২-১১-২০২৫
